চাক্তাই খাল: নৌবাণিজ্যের সোনালি দিন পেরিয়ে এখন জলাবদ্ধতার আবর্তে

চট্টগ্রাম শহরের পানি নিষ্কাশনের সবচেয়ে বড় পথ চাক্তাই খাল। কালুরঘাট, বহদ্দারহাট, টেরীবাজার, চান্দগাঁ, বাকলিয়া, শুলকবহর, বক্সিরহাট ও চকবাজারসহ অনেক এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই খালই শহরের প্রধান খাল। অথচ এখন এটি শহরের অন্যতম বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বয়স দুই-তিন শতাব্দীর বেশি নয়
চাক্তাই খালের বয়স দুই-তিন শতাব্দীর বেশি নয়। ২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এক মানচিত্রে স্কটিশ জেনারেল জন চিপ দেখিয়েছিলেন, খালের পূর্বদিকে তখনো শহর গড়ে ওঠেনি। সেসময় কর্ণফুলী নদী ওইদিক দিয়ে প্রবাহিত হতো। গবেষক হারুন রশীদ তার 'চিৎ-তৌৎ-গং' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর খালের পূর্ব অংশ জেগে উঠতে পারে।
ধারণা করা হয়, কর্ণফুলী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের পর চাক্তাই খালই বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রধান পথ হয়ে টিকে থাকে। ফলে এর বয়স তিনশো বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। ১৮১৭ সালের এক মানচিত্রেও চট্টগ্রামে তিনটি বড় খালের কথা পাওয়া যায়, যার একটি হলো চাক্তাই খাল।
২০০-৩০০ বছর আগে চাক্তাই খালের রূপ, জীবন ও ব্যবহারের সঙ্গে আজকের চাক্তাই খালের বিস্তর পার্থক্য। মাত্র ২৫-৩০ বছর আগেও এই খাল দিয়ে কর্ণফুলী নদী হয়ে বন্দর থেকে আমদানি করা ভোগ্যপণ্য সারা দেশে যেত। নৌকা-সাম্পানে বোঝাই করে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, বোয়ালখালীতে পৌঁছে দেওয়া হতো।
এখান থেকে কর্ণফুলী নদী ও চানখালী খাল হয়ে সাঙ্গু নদীর মাধ্যমে পণ্য পৌঁছাত বান্দরবানের থানচি ও রুমা উপজেলায়। শহরের গদী নৌকাগুলোও বিভিন্ন পণ্য নিয়ে মির্জা খাল, খন্দকিয়া ও কৃষ্ণ খালী হয়ে হালদা নদীতে চলাচল করত। তখন গ্রামের হাটবাজারে সরবরাহের প্রধান বাহন ছিল এসব নৌকা। জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদী থেকেই যাত্রা শুরু হতো।
তবে সবসময় যাত্রা নির্বিঘ্ন হতো না। কখনো নৌকা পড়ত ডাকাতের কবলে। চাল-ডালসহ শুকনো রসদ লুটে নিয়ে তারা নৌকা ছেড়ে দিত।
ইসলামাবাদ রাইচ মিলের কর্ণধার আব্দুর রহমান এমন অভিজ্ঞতার কথা শোনান। পাকিস্তান আমল থেকে চাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তিনি। বয়স এখন প্রায় সত্তর। তার ভাষায়, তখন লেনদেন হতো মৌখিক চুক্তিতে, আর প্রাপ্তি রসিদ মানে ছোট কাগজে হাতে লেখা কয়েকটি লাইন—"এত বস্তা মাল বুঝিয়া পাইলাম।"
আব্দুর রহমান আরও জানান, তখন খাল ছিল অনেক চিকন আর খরস্রোতা। সেখান দিয়েই ৮০-১০০ মণ মালবোঝাই নৌকা চলত। এখন খাল প্রশস্ত হলেও আগের মতো পণ্য পরিবহন হয় না। বরং একসঙ্গে আগের তুলনায় পণ্য ও নৌযানের সংখ্যা উভয়ই কমে এসেছে।

মাছ ধরা হতো
কোনো কোনো নৌকা এসে মালামাল নামিয়ে দিয়ে সেদিনই আবার ফেরত যেত। তবে দূরের যাত্রার জন্য—যেমন সন্দ্বীপ বা হাতিয়ারগামী নৌকাগুলো—দুই-তিন দিন থেকে মাল নামিয়ে নতুন মাল বোঝাই করে তবেই যাত্রা করত। বড় বড় সাম্পানে করে আসতেন সওদাগর-ব্যাপারীরাও। তাদের থাকার জন্য ছিল বোর্ডিং। আজও খাতুনগঞ্জ এলাকায় গেলে কর্ণফুলী বোর্ডিং চোখে পড়ে।
মাঝি বা নৌকার লোকেরা অনেকসময় নৌকাতেই থাকতেন। সেখানেই রান্না, সেখানেই ঘুম। রাত হলে তারা গান ধরতেন। সারাদিনের কাজ শেষে একসাথে বসে একদিকে মাছ ভাজা, অন্যদিকে, চলত গলাছেড়ে গান। দোকানপাট বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা যখন বাড়ি ফিরতেন, বাতাসে ভেসে আসত সেই গানের সুর। মাছগুলো ধরা হতো অনেকসময় খাল থেকেই। ভরযৌবনে চাক্তাই খালে জেলেদের জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। সেসব মাছ কেরোসিনের আগুনে হলুদ-লবণ-মরিচ দিয়ে ভাজা হতো।
নৌকা-সাম্পান বা ট্রলারে আসা মাল বোঝাই বা খালাস করতেন শ্রমিকরা। তাদেরই একজন মোহাম্মদ সেলিম। ২০০৭ সালে ট্রলার থেকে কাঁধে ধান নামানোর সময় সিঁড়ি ভেঙে পড়ে গিয়ে তার কোমর ভেঙে যায়। প্রাণে বেঁচে গেলেও আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেননি। খালের পাড়ে ছোট দোকান দিয়েই জীবিকা চালাচ্ছেন তিনি। ষোলো বছর বয়স থেকে মাল টানার কাজ শুরু করেছিলেন। আশির দশকে ভোলা থেকে জীবিকার তাগিদে এসে খালের পাড়ে ভাড়া বাসায় ওঠেন।
তার স্মৃতিতে, "পানি তখনও নোংরা ছিল। নদীর পাড়ে ছিল ভাসমান টয়লেট। প্রতিদিনই ৫০-৬০টা বড় ট্রলার ভিড়ত। স্লুইসগেট দেওয়ার পর আর বড় ট্রলার আসে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাস্তা বানাতে অনেক বাড়ি-ঘর ভাঙা হয়। আগে গাড়ি বলতে ছিল গরুর গাড়ি আর ঠেলা গাড়ি। আশেপাশে সব ব্যবসায়ীর ঘরবাড়ি ছিল—নিচতলায় দোকান, ওপরে বাসা। ঘরের ভেতর দিয়েই সিঁড়ি লাগিয়ে মাল ওঠানামা করা হতো। পঁচিশ বছর আগেও দিনে চাক্তাই খালের এই জায়গায় হাঁটার জায়গা পাওয়া যেত না।"
তারও আগে পাকিস্তান আমলে খালের পানি ছিল স্বচ্ছ। ব্যবসায়ীরা সেই পানিতেই ওযু-গোসল করতেন। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে ট্রাকে পণ্য পরিবহন শুরু হয়। ২০০০ সালের পর থেকে সড়কপথই প্রধান হয়ে ওঠে। খালের আশেপাশে দোকানের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় দশ হাজারের মতো হয়েছে বলে প্রবীণ ব্যবসায়ীরা মনে করেন।

সাজ্জাদ স্টোরের কর্ণধার মোহাম্মদ আলী নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যবসা করছেন। তার তিনটি দোকান—চাল, ডাল আর শুঁটকির। তিনি নৌকায় মাল আসার শেষ সময়টা দেখেছেন। তার মতে, "ব্যবসার জন্য সড়কপথেই সুবিধা। এখন বেশি পণ্য আসতে পারছে, পিকআপে মাল আসা-যাওয়া হচ্ছে। তবে আগের মতো একচেটিয়া ব্যবসা আর নেই।"
ইসলামাবাদ রাইস মিলের আব্দুর রহমান বলেন, "আগে দিনাজপুর-নওগাঁ থেকে ধান আসত চট্টগ্রামে। সেই ধান থেকে চাল করে আবার ফিরিয়ে দিতাম। এখন উল্টো হচ্ছে—আমরা ধান পাঠাচ্ছি, ওরা চাল পাঠাচ্ছে। জেলায় জেলায় আধুনিক কারখানা হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসা কমে গেছে।"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজরুল কিবরিয়া তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশ আমলের ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস জরিপ) অনুযায়ী চাক্তাই খালের প্রস্থ ছিল প্রায় ৩৫ ফুট। রিভিশনাল সার্ভে (আরএস জরিপ) অনুযায়ী তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ ফুটে। বর্তমানে এলাকাভেদে কোথাও প্রস্থ ৭০ ফুট, কোথাও ৫০, আবার কোথাও মাত্র ২০ ফুট।
২০০৩-০৪ সালে খালের গভীরতা ছিল সাড়ে ৯ থেকে ১২ ফুট। এখন কোথাও কোথাও তা নেমে এসেছে মাত্র ৩ থেকে ৪ ফুটে। শহরের মধ্যে কোনো রেলিং বা বেষ্টনী ছাড়া ড্রেনের মতো উন্মুক্ত অবস্থায় থাকা এই খালে আশপাশের কারখানা ও বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে। ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়ে বর্ষায় জলাবদ্ধতা এখন চট্টগ্রামবাসীর নিত্যদিনের ভোগান্তি।
বিশেষ করে ডিসি সড়ক, বাকলিয়া, চকবাজার, ফুলতলা, কে বি আমান আলী সড়ক, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, প্রবর্তক মোড়, হালিশহর, আগ্রাবাদ, ওয়াসা মোড়সহ বহু এলাকা পানিতে ডুবে যায়। সরু এসব খালে পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। প্রতি বর্ষায় চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জের পাইকারি বাজার তলিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার ও পরিকল্পনা কমিশনের ২০২১ সালের এক জরিপে বলা হয়, গত এক দশকে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ ও কোরবানিগঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২,৫১৭ কোটি টাকারও বেশি। শুধু ২০২০ সালেই ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৩ আগস্ট ২০২৫)।
পণ্য আনা-নেওয়া সহজ হয়েছে, বেড়েছে খরচ
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উন্নতি হয়েছে। চাক্তাই খালের মোহনায় কর্ণফুলীর সঙ্গে সংযোগস্থলে স্লুইসগেট বসানোর ফলে আশপাশের বাণিজ্যিক এলাকা জলাবদ্ধতা থেকে অনেকটা রেহাই পেয়েছে। কিন্তু এতে ওই অংশের খালে পানির প্রবাহ কমে গিয়ে বর্ষায়ও খালটি পরিণত হয়েছে প্রায় আবর্জনার ভাগাড়ে। তার ওপর স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, রাজনৈতিক নেতা, সন্ত্রাসী ও কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তার প্রভাবে কর্ণফুলীর তীর ও চাক্তাই খালের মোহনা সংলগ্ন প্রায় ৩০ একর জমিতে অবৈধভাবে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও সমিতি গড়ে উঠেছে। এগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে নিম্নআয়ের মানুষদের কাছে।

তবুও কিছু এলাকায় চাক্তাই খালের পুরোনো রূপ এখনও টিকে আছে। যেমন–ভাঙাপুল এলাকার খাল এখনো প্রশস্ত ও খরস্রোতা, সেখানে তেমন ময়লা নেই। নতুন চাক্তাই অংশেও খাল চওড়া এবং সেখানে পণ্যবাহী নৌযান চলে। ফলে দুই পাড় এখনও সরগরম থাকে ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও মাঝিদের হাঁকডাকে।
তবে এখন সিংহভাগ পণ্য পরিবহন হয় ট্রাকে। চট্টগ্রাম শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ১২টি স্লুইসগেট আছে, যেগুলো দিয়ে প্রায় ১৮ ফুট দীর্ঘ নৌযান চলাচল করতে পারে। বড় নৌযান আর আসে না। যদিও ব্যবসায়ীদের চাহিদায় ২২ ফুটের একটি বড় নৌযান চলাচলের পথ তৈরি করা হয়েছে, তা সীমিত অংশেই ব্যবহার হয়। নৌকাগুলো সাধারণত অভয়মিত্র ঘাটে থামে। সেখান থেকে ভ্যানে বা ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে পণ্য দোকানের সামনে আনা হয়। ফলে খরচ বেড়ে গেছে। আগে নৌকা সরাসরি খালের পাড়ে এসে ভিড়ত, দোকানের সামনে নামত মালামাল। তখন একজন শ্রমিক এক বস্তা মাল নামাতে নিত ১-২ টাকা। এখন একই কাজে খরচ হয় ২৫ টাকা।
তবুও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পণ্য আনা-নেওয়া এখন অনেক সহজ হয়েছে। খরচ বেড়েছে বটে, তবে পরিবহনে আগের মতো জটিলতা আর নেই।
ছবি: রফিয়া মাহমুদ প্রাত/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড