গাজা সিটির 'দখল' নিতে ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা তলব করল ইসরায়েল

গাজা সিটি দখলের জন্য একটি পরিকল্পিত স্থল অভিযানের জন্য প্রায় ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে তলব করছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য, গাজা সিটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
ইসরায়েলের একজন সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে এই রিজার্ভ সেনাদের সামরিক দায়িত্বে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। তবে অভিযানে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ সৈন্যই হবেন সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সদস্য।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ মঙ্গলবার এই অভিযান পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন এবং চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জাইতুন এবং জাবালিয়া এলাকায় ইতোমধ্যে ইসরায়েলি সেনারা অভিযান পরিচালনা করছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, গাজা সিটির কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ গাজায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।
ইসরায়েলের অনেক মিত্র দেশ এই পরিকল্পনার নিন্দা করেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সতর্ক করেছে যে, ২২ মাস ধরে চলা যুদ্ধের পর আরেকটি বড় ধরনের অভিযান এবং ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি 'ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়' ডেকে আনবে।
গত মাসে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি সংক্রান্ত পরোক্ষ আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার পর ইসরায়েলি সরকার পুরো গাজা উপত্যকা দখলের ঘোষণা দেয়।
অভিযান শুরুর আগেই আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীরা একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। তারা ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি এবং গাজায় আটক থাকা প্রায় ৫০ জন জিম্মির মধ্যে অর্ধেককে মুক্তি দেওয়ার একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন। হামাস সোমবার জানিয়েছে যে তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।
ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো জবাব দেয়নি। তবে, মঙ্গলবার ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে তারা আর কোনো আংশিক চুক্তি মানবেন না। তারা সব জিম্মির মুক্তির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি দাবি করেছেন। ধারণা করা হয়, জিম্মিদের মধ্যে মাত্র ২০ জন বেঁচে আছেন।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে বলেছে, মে মাসে শুরু হওয়া 'অপারেশন গিডিয়নস চারিওটস' অভিযানের পরবর্তী ধাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বুধবার ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে ডাকার আদেশ জারি করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, ইতোমধ্যে ডেকে পাঠানো ২০ হাজার রিজার্ভ সেনার বর্তমান আদেশের মেয়াদ বাড়ানো হবে।
একজন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কমান্ডাররা গাজা সিটি ও এর আশেপাশে একটি 'ধীরে ধীরে' এবং 'সুনির্দিষ্ট' অভিযানের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইয়াল জামির আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তার মতে, এই অভিযানে পাঁচটি ডিভিশন অংশ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজের ভাষ্যে, "অভিযান শেষ হলে গাজার চেহারা বদলে যাবে এবং এটি আর অতীতের মতো থাকবে না।"
খবরে বলা হয়, তিনি গাজা সিটির বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে 'স্থানান্তর' করার একটি পরিকল্পনাও অনুমোদন করেছেন, যার মধ্যে উপকূলীয় আল-মাওয়াসি এলাকাও রয়েছে। সেখানে সামরিক বাহিনী অতিরিক্ত খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র এবং ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন শুরু করছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য হলো হামাসের হাতে থাকা সব জিম্মিকে মুক্ত করা এবং ফিলিস্তিনি এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে 'সম্পূর্ণ পরাজিত' করা।
আইডিএফ বুধবার আরও জানিয়েছে যে গিভাতি ব্রিগেড উত্তরের শহর জাবালিয়া এবং গাজা সিটির উপকণ্ঠে পুনরায় অভিযান শুরু করেছে। সেখানে তারা 'মাটির উপরে ও নিচে সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করছে, সন্ত্রাসীদের নির্মূল করছে এবং অভিযানিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে'।
এতে বলা হয়েছে, 'ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে' বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণে সরে যেতে বলা হচ্ছে।
গাজার হামাস-শাসিত সিভিল ডিফেন্স এজেন্সির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল মঙ্গলবার এএফপি সংবাদ সংস্থাকে বলেন, শহরের জাইতুন ও সাবরা এলাকায় পরিস্থিতি 'খুবই বিপজ্জনক এবং অসহনীয়' এবং সেখানে 'মাঝে মাঝে গোলাবর্ষণ চলছে'।
সংস্থাটি জানিয়েছে, বুধবার গাজা জুড়ে ইসরায়েলি হামলায় ২১ জন নিহত হন।
ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, গাজা সিটির পশ্চিমে শাতি শরণার্থী শিবিরে একটি বাড়িতে বোমা হামলায় তিন শিশু ও তাদের বাবা-মা নিহত হন।
জাতিসংঘের সংস্থা এবং এনজিওগুলো নতুন এই অভিযানের মানবিক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করছে।
সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, 'গাজা সিটিতে সামরিক অভিযান তীব্র করার ইসরায়েলি পরিকল্পনা এমন মানুষের উপর ভয়াবহ মানবিক প্রভাব ফেলবে যারা ইতোমধ্যে ক্লান্ত, অপুষ্টিতে ভুগছে, শোকাহত, বাস্তুচ্যুত এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক জিনিস থেকে বঞ্চিত।'
'কয়েক লক্ষ মানুষকে দক্ষিণে যেতে বাধ্য করা আরও একটি বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং এটি জোরপূর্বক স্থানান্তর হিসেবে গণ্য হতে পারে।'
তারা আরও বলেছে, বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের দক্ষিণে যেখানে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেই এলাকাগুলো 'অতিরিক্ত জনবহুল এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপ্রস্তুত'।
'দক্ষিণের হাসপাতালগুলো তাদের ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী নিয়ে কাজ করছে। উত্তর থেকে আরও রোগী আসলে পরিস্থিতি জীবন-মরণ সমস্যা তৈরি করবে।'
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজায় অভিযান শুরু করে। ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
গাজার হামাস-শাসিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, তখন থেকে গাজায় কমপক্ষে ৬২,১২২ জন নিহত হয়েছেন।
গাজার বেশিরভাগ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে; ৯০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে বলে অনুমান করা হয়; স্বাস্থ্যসেবা, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে; এবং জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, খাদ্যের অভাবে সেখানে 'দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে'।