গাজা সিটির দখল নিতে প্রথম ধাপের অভিযান শুরু ইসরায়েলের

গাজা সিটি দখল ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পরিকল্পিত স্থল অভিযানের 'প্রাথমিক পদক্ষেপ' শুরু করেছে ইসরায়েল। ইতোমধ্যেই শহরের উপকণ্ঠে অবস্থান নিয়েছে দেশটির সেনারা। খবর বিবিসির।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, জেইতুন ও জাবালিয়া এলাকায় সেনারা এখন কার্যক্রম চালাচ্ছে। মূল অভিযানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ মঙ্গলবার এ অভিযান অনুমোদন দেন। তবে বিষয়টি সপ্তাহের শেষ দিকে নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে প্রায় ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে ডাকার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সক্রিয় দায়িত্বে থাকা সেনাদের অভিযানে নিয়োজিত করা সহজ হবে।
এদিকে হামাস অভিযোগ করেছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি আটকে রেখে ইসরায়েল সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে 'নৃশংস যুদ্ধ' চালিয়ে যেতে চাইছে। খবর রয়টার্সের।
ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিগগিরই গাজা সিটি থেকে লাখো ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হতে পারে। তবে দেশটির এই পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছে অনেক মিত্র রাষ্ট্র। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বুধবার সতর্ক করে বলেন, এই পদক্ষেপ 'দুই জাতির জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং পুরো অঞ্চলকে এক অন্তহীন যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে'।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) জানিয়েছে, নতুন করে বাস্তুচ্যুতি ও লড়াইয়ের তীব্রতা গাজার ২১ লাখ মানুষের জন্য 'আগেই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে'।
গত মাসে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় নিয়ে পরোক্ষ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর ইসরায়েল পুরো গাজা উপত্যকা দখলের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, টানা ২২ মাসের যুদ্ধের পর হামাস এখন 'ক্ষতবিক্ষত ও দুর্বল'।
বুধবার এক টেলিভিশন ব্রিফিংয়ে আইডিএফ মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফ্রিন বলেন, 'আমরা গাজা নগরীতে হামাসের ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়াবো। এটি ওই সন্ত্রাসী সংগঠনের সরকারি ও সামরিক সন্ত্রাসের ঘাঁটি। আমরা ভূ-পৃষ্ঠের ওপর ও নিচের সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করব এবং জনগণের হামাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিন্ন করব।'
তিনি জানান, অভিযান শুরু করতে আর অপেক্ষা করছে না আইডিএফ। 'আমরা প্রাথমিক পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই শুরু করেছি। এখন আইডিএফ সৈন্যরা গাজা নগরীর প্রান্তভাগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।'
ডেফ্রিন আরও জানান, দুটি ব্রিগেড জেইতুন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের সন্ধান মিলেছে, যেখানে অস্ত্র মজুত ছিল। আরেকটি ব্রিগেড কাজ করছে জাবালিয়া এলাকায়।
গাজা সিটিতে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে স্থানীয়দের আগে থেকেই সরে যাওয়ার সতর্কবার্তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের সেনা মুখপাত্র ড্যানিয়েল ডেফ্রিন।
ফ্রান্সের সংবাদ সংস্থা এএফপিকে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসসাল বলেন, গাজা সিটির জেইতুন ও সাবরা মহল্লার পরিস্থিতি 'খুবই বিপজ্জনক ও অসহনীয়'।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বুধবার ইসরায়েলি হামলায় গাজাজুড়ে অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে তিন শিশু ও তাদের বাবা-মা রয়েছেন। গাজা সিটির পশ্চিমে শাতি শরণার্থী শিবিরের বদর এলাকায় তাদের বাড়িতে বোমা বর্ষণ করা হয়।
ডেফ্রিন আরও জানান, গাজায় হামাসের হাতে আটক ৫০ জন জিম্মির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সেনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে গাজা সিটিতে সেনা অভিযান শুরু হলে তাদের জীবনও ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবারগুলো।
আইসিআরসি সতর্ক করে বলেছে, গাজায় সামরিক অভিযান আরও জোরদার হলে ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ ও জিম্মিদের জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, 'মাসের পর মাস সংঘাত ও বারবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর মানুষ এখন চরমভাবে ক্লান্ত। তাদের আর চাপ নয়, প্রয়োজন স্বস্তি। ভয়ের বদলে দরকার শান্তির নিশ্বাস। মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে তাদের হাতে পৌঁছাতে হবে খাদ্য, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি এবং নিরাপদ আশ্রয়।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'সামরিক অভিযানের বিস্তার কেবল ভোগান্তি বাড়াবে, আরও পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করবে এবং এক অপরিবর্তনীয় মানবিক সংকটের ঝুঁকি তৈরি করবে। একইসঙ্গে এতে জিম্মিদের জীবনও বিপন্ন হতে পারে।'
তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও গাজায় মানবিক সহায়তার দ্রুত এবং বাধাহীন প্রবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে সংস্থার বিবৃতিতে।
এদিকে মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিশর নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। এতে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি এবং প্রায় অর্ধেক জিম্মি মুক্তির বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। হামাস সোমবার জানিয়েছে, তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তবে ইসরায়েল এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো জবাব দেয়নি। মঙ্গলবার দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আর কোনো আংশিক সমঝোতা মানবেন না। সব জিম্মি মুক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তিই হবে তাদের শর্ত।
বুধবার হামাস এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মধ্যস্থতাকারীদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উপেক্ষা করেছেন। সংগঠনটির ভাষায়, তিনি 'যেকোনো সমঝোতার আসল বাধাদানকারী'। খবর রয়টার্সের।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল সামরিক অভিযান শুরু করে। ওই হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এরপর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬২ হাজার ১২২ জন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা নিহতের হিসাবের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের তথ্যকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে মানছে।