গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হামাস; যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ইসরায়েল

গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে প্রস্তুত হামাস। তারা জানিয়েছে, সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তারা অনুমোদন দিয়েছে। এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন এবং মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কারণে আরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সোমবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে হামাস বলেছে, 'হামাসসহ ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতাকারীদের দেওয়া গতকালের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার বার্তা দিয়েছে।' ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েল এবং চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, ইসরায়েল হামাসের প্রতিক্রিয়া পেয়েছে।
আল জাজিরাকে এক আলোচনাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে ৬০ দিনের জন্য সামরিক অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করা। এ সময় ইসরায়েলি সেনারা অবস্থান পরিবর্তন করবে, যাতে মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে পারে।
এই সময়সীমার মধ্যেই বন্দি ৫০ জন ইসরায়েলির মধ্য থেকে ২৫ জনকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হবে।
সূত্রটি আরও বলেছে, নতুন এই প্রস্তাবটি 'একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধানের পথে সূচনা হতে পারে।'
কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান বিন জাসিম আল থানি কায়রোতে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠক করার পর হামাস তাদের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়।
তবে অতীতের ব্যর্থ আলোচনার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে এ ঘোষণা যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে—এমন নিশ্চয়তা দেয় না।
গত দুই বছরে হামাস একাধিক যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলি বন্দি ও ফিলিস্তিনি বন্দি বিনিময়ের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আলোচনার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ নিয়ে মতপার্থক্য। হামাস চায় যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তি।
কিন্তু ইসরায়েল চায় কেবল একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি, যাতে তাদের বন্দিদের মুক্তির পর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও বাস্তুচ্যুত করার অভিযান আবারও চালিয়ে যেতে পারে।
তবে ইসরায়েল গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। একসময়ের গাজার সবচেয়ে বড় ও প্রাণবন্ত নগর কেন্দ্রটিতে ধারাবাহিকভাবে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেখানে বসবাসরত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে গাজা সিটি ঘিরে পরিকল্পনা এবং 'মিশন সম্পন্ন করা' নিয়ে আলোচনা করেছেন। নেতানিয়াহুর দাবি, হামাস বর্তমানে 'ভয়াবহ চাপের' মধ্যে রয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ বলেন, হামাস এখন কেবল বন্দিমুক্তি নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী হয়েছে কারণ তারা আশঙ্কা করছে, ইসরায়েল সত্যিই গাজা সিটি দখল করতে বদ্ধপরিকর।
কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ গাজায় কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিরই বিরোধিতা করেছেন।
তিনি বলেন, 'গাজা দখলের চাপের কারণে হামাস ভয়াবহ সংকটে রয়েছে, কারণ এটি তাদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেবে এবং তাদের গল্পের সমাপ্তি ঘটাবে। তাই হামাস একটি আংশিক চুক্তিতে ফিরতে চাইছে এটি ঠেকানোর জন্য। ঠিক এই কারণেই আমাদের হাল ছাড়া যাবে না এবং শত্রুকে আরেকটি জীবন দেওয়া যাবে না।'
আল জাজিরার সাংবাদিক হামদাহ সালহুত জানিয়েছেন, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে গাজা সিটিতে অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত যুদ্ধরত সেনা তাদের নেই। সেনাবাহিনী ইসরায়েলের ভেতরে এবং বিদেশে বারবার বাধ্যতামূলক নিয়োগের ডাক দিচ্ছে সেনাশক্তি বাড়ানোর জন্য।
সালহুত বলেন, 'তারা বলছে পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে কখন এবং কীভাবে তা হবে, তা স্পষ্ট নয়।' তিনি আরও বলেন, 'গাজা সিটি দখল করাকে ইসরায়েলি সেনারা তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।'
নতুন আলোচনা
নতুন আলোচনার ঘোষণা দেওয়া এবং আলোচনা পুনরায় শুরুর তারিখ নির্ধারণ করার কথা ছিল মধ্যস্থতাকারীদের।
তবে কাতার ও মিসরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা যায়নি।
কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় জানুয়ারিতে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল, তা মার্চে ইসরায়েল একতরফাভাবে ভেঙে দেয়। এরপর থেকে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে মানবিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
এ পর্যন্ত ইসরায়েল-সৃষ্ট এই অনাহার সংকটে ২৬০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে দোহায় মধ্যস্থতায় হওয়া সর্বশেষ পরোক্ষ আলোচনা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলার পর ২৫ জুলাই কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়।
সোমবার গাজার রাফাহ সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাদর আবদেলাত্তি বলেন, 'আমাদের বিদ্যমান যৌথ প্রচেষ্টাকে সুসংহত করতে এবং দ্রুত চুক্তি করার জন্য দুই পক্ষের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতে কাতারের প্রধানমন্ত্রীও সফরে এসেছেন।'
গাজা উপত্যকায় দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে—যেখানে জাতিসংঘ সংস্থা ও ত্রাণ সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই মানবিক বিপর্যয়ের সতর্কতা দিয়েছে—আবদেলাত্তি একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, 'মাঠের বর্তমান পরিস্থিতি কল্পনারও বাইরে।'
সোমবার মিসরের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ গাজা উপত্যকাকে পুনর্দখল এবং ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রচেষ্টার গুরুত্বের ওপরও জোর দিয়েছেন।
গণহত্যা কেবল আলোচনার মাধ্যমে শেষ করা যায় না
কাতারের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-আরিয়ান কাতারের প্রধানমন্ত্রীর মিসর সফরের প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন।
তিনি সতর্ক করেছেন, 'গণহত্যা কেবল আলোচনার মাধ্যমে শেষ করা যায় না।'
তিনি বলেন, এর আগে এ ধরনের আলোচনা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগুলো আটকে গেছে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবে।
আল-আরিয়ান আল জাজিরাকে বলেছেন, ইসরায়েল এই গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা নতুন, ভয়ঙ্কর ও অপ্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছে গেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে আন্তর্জাতিক চাপের অভাব রয়েছে।
অধ্যাপক জোর দিয়ে বলেছেন, 'ঐতিহাসিকভাবে, গণহত্যা আলোচনা মাধ্যমে শেষ হয় না। সাধারণত তা তখনই শেষ হয় যখন যে পক্ষ গণহত্যা করেছে তাকে বাইরের চাপ বা কোনো ধরনের বহিরাগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাধ্য করা হয়, যা এখনো ঘটেনি।'
সোমবার, মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় জনগণকে দারিদ্র্য এবং অনাহারে ফেলার 'সচেতন নীতি' অবলম্বনের অভিযোগ করেছে, যখন জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো গাজায় দুর্ভিক্ষের সতর্কতা জারি করেছে।
অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ও ক্ষুধার্ত শিশুদের চিকিৎসা করা মেডিকেল স্টাফদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, 'ইসরায়েল দখলকৃত গাজা উপত্যকায় সচেতনভাবে অনাহারের অভিযান চালাচ্ছে।'
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই অঞ্চলে সহায়তা পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্য নিন্দা জানিয়েছে।