কবরেও একা যেতে হবে, দুর্নীতি করলে জেলখানায়ও একা যেতে হবে: কলিমউল্লাহকে বিচারক

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গ্রেপ্তার রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে উদ্দেশ্য করে আদালতের বিচারক বলেছেন, 'কবরেও একা যেতে হবে, দুর্নীতি করলে জেলখানায়ও একা যেতে হবে।'
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালতে শুনানি চলাকালে বিচারক তাকে এ কথা বলেন।
শুনানিতে ড. কলিমউল্লাহ আদালতকে বলেন, 'আজ সকালে আকস্মিকভাবে নাস্তার পর ডিবি পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি আপত্তি করিনি।'
ড. কলিমউল্লাহর এই কথার জবাবে বিচারক তখন বলেন, 'আপনি আপত্তি করবেন কেন? আপনার তো জেলে যেতে হবে। কবরেও একা যেতে হবে, দুর্নীতি করলে জেলখানায়ও একা যেতে হবে। সঙ্গে কেউ যাবে না। দুর্নীতি যারা করছেন, তারা জেলে পচছেন। আর দুর্নীতির টাকায় (আত্মীয়রা) অনেকে বিদেশ ভ্রমণে মজা করছেন।'
এদিন দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। বিকাল ৪টার দিকে তাকে সাদা একটি মাইক্রোবাসে করে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাকে সরাসরি এজলাসে তোলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহজ বিন ইসলাম তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।
বিকাল ৪টা ১৬ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। পরে ৪টা ২২ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। তখন ড. কলিমউল্লাহ কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান।
ড. কলিমউল্লাহর পক্ষে তার আইনজীবী শাহনাজ সুমি জামিন চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, 'নিয়মবর্হিভূতভাবে ড. কলিমউল্লাহ কিছু করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সব কিছুতে একার বিষয় থাকে না। চাইলেই দুই-চারজন টাকা আত্মসাৎ করতে পারেন না। সবকিছু ডকুমেন্টারি ব্যাপার। তিনি কিছু আত্মসাৎ করেননি। বিধি, নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সবকিছু করেছেন। তিনি বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ। তার জামিনের প্রার্থনা করছি।'
এরপর দুদকের পক্ষে প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, 'দুদকের মামলা হঠাৎ করে হয় না। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান হয়। আসামিও সে বিষয়ে অবগত থাকেন।'
এরপর বিচারকের প্রশ্নের মুখোমুখি হন ড. কলিমউল্লাহ। তিনি কত সালে নিয়োগ পান, তা জানতে চান বিচারক। জবাবে ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'আমাকে প্রথমে বিইউপিতে উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন সরকার একদিনের জন্য আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করে। পরবর্তীতে আমাকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।'
বিচারক বলেন, '২০১৭ সালে?'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'হ্যাঁ।'
বিচারক জানতে চান- 'ক্যাম্পাস কোথায়?'
কলিমউল্লাহ বলেন, 'রংপুরে।'
বিচারক বলেন, 'আপনি তো ফুল টাইম ঢাকায় থাকতেন।'
কলিমউল্লাহ বলেন, 'না, স্যার। আমি ঢাকায় থাকলেও ওখানে আমার বাংলো ছিল। এর জন্য বেতনের ৪০ শতাংশ কেটে নেওয়া হতো।'
বিচারক বলেন, 'চাকরিকালে আপনি তো এক হাজার ৩৫২ দিনের মধ্যে এক হাজার ১১৫ দিনই ঢাকায় ছিলেন।'
জবাবে ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অন্যায় আবদার করতেন। তার কারণে ক্যাম্পাসে যেতাম না। আমি এই আবদারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করি। তিনি রাগান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন। প্রতিদিন ১৭-১৮ ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই প্রথম, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষামন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এ কারণে দীপু মনি আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন।'
বিচারক বলেন, আপনি ও আপনার মা একই নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন?'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'তিনি (তার মা) মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ডিজি (মহাপরিচালক) ছিলেন। এজন্য সরকার নিয়োগ বোর্ডে সদস্য করেন।'
বিচারক বলেন, 'আপনি কি ভিসি, বিভাগীয় প্রধান ও ডিন ছিলেন?'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'আমিই প্রথম না। আমার আগের ভিসির ধারাবাহিকতা রক্ষায় এসব দায়িত্বে ছিলাম। বিশেষ পরিস্থিতিতে এ দায়িত্বে থাকতে হয়েছে।'
বিচারক জানতে চান, 'চার বছরে উন্নয়ন খাতে কোনো টাকা পেয়েছেন?'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'আমার আগের ভিসি নুর নবীর সময় ৯৯ কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ চলমান রেখেছি। আর নকশা পরিবর্তনের অভিযোগ আগের ভিসির বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটাই উন্নয়ন প্রজেক্ট। আমি এসে নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছি।'
বিচারক বলেন, 'নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য আপনার বিরুদ্ধেই।'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'নো, নেভার, নেভার।'
এ সময় দুদক প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি বলেন, 'উনি ১৭ ঘণ্টা কাজ করেছেন। আমরা তো তাকে টকশোতে দেখেছি।'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'সেটা তো রাতে।'
এ সময় বিচারক দুদক প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান, তার বিরুদ্ধে অন্য মামলা আছে কি না। আদালতকে জানানো হয়, এই মামলাই আছে। নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের তদন্ত শুরু হবে।
বিচারক বলেন, 'অভিযোগ আগে, তদন্ত হোক। আপনি কি করেছেন, সেটা আলিমুল গায়েব জানেন, আপনি জানেন। কিছুদিন পর দুদক জানবে। এরপর মানুষ জানবে।'
তখন ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'গত মাসের ১৮ তারিখে মামলার বিষয় ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। আমি ভেবেছিলাম, দুদক থেকে আমাকে তলব করা হবে। আজ সকালে আকস্মিকভাবে নাস্তার পর ডিবি পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। আপত্তি করিনি।'
বিচারক বলেন, 'আপনি আপত্তি করবেন কেন? আপনার তো জেলে যেতে হবে। কবরেও একা যেতে হবে, জেলখানায়ও একা যেতে হবে। সঙ্গে কেউ যাবে না। দুর্নীতি যারা করছেন, তারা জেলে পচছেন। আর দুর্নীতির টাকায় (আত্মীয়রা) অনেকে বিদেশ ভ্রমণ করছেন।'
ড. কলিমউল্লাহ বলেন, 'মাননীয় আদালত, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। আমি কমিশন্ড অফিসার, গ্রেড-১ পারসন।'
বিচারক তখন বলেন, 'আপাতত আপনাকে জেলে যেতে হচ্ছে।'
পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কলিমউল্লাহসহ ৫ জনকে আসামি করে গত ১৮ জুন মামলাটি দায়ের করে দুদক।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য ও প্রকল্প পরিচালক এ কে এম নূর-উন-নবী, সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, ঠিকাদার মো. আ. সালাম বাচ্চু এবং এম এম হাবিবুর রহমান।