'বৃক্ষের দীক্ষা' : বন বাঁচাতে থাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অভিনব রীতি

থাইল্যান্ডের ছাইয়াফুম প্রদেশের একটি ঘন জঙ্গলে সকালের দিকেই জড়ো হন তিনজন গেরুয়া বসনে আবৃত বৌদ্ধ ভিক্ষু ও প্রায় ১২জন ভক্ত। প্রার্থনা পাঠ শেষে তারা একটি বিশাল গাছকে ঘিরে ধরে তাতে একখণ্ড উজ্জ্বল কমলা কাপড় জড়ান—যেমনটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গায়ে দেখা যায়।
তবে এটি ছিল না কোনো প্রচলিত বৌদ্ধ আনুষ্ঠানিকতা। এটি ছিল 'বৃক্ষ দীক্ষা' নামের একটি প্রতীকী কর্মসূচির অংশ, যেখানে বিপন্ন গাছগুলোকে ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা দিয়ে রক্ষা করা হয় কাঠ কাটা বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে।
আধ্যাত্মিকতা ও পরিবেশ আন্দোলনের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই রীতি আজ থাইল্যান্ডের বনবাসী ভিক্ষুদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। প্রাচীন বৌদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে আধুনিক পরিবেশ সচেতনতার মিলন ঘটিয়ে তারা টিকে থাকা বনাঞ্চল রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন।
"বৌদ্ধ সমাজে ভিক্ষুদের অনেক সম্মান দেওয়া হয়। গেরুয়া বসন ও মুণ্ডিত মস্তক দেখলেই মানুষ শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। এই বসন বুদ্ধ ও তার ধর্মের বিজয়ের প্রতীক, এটি সাধুত্বের প্রতীক," বলেন থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওয়াত পা মহাওয়ান মঠের ভিক্ষু ভেনারেবল ধাম্ম কারো, যিনি ওই দীক্ষা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।
"যখন আমরা কোনো গাছে এই গেরুয়া বসন জড়াই, তখন সেটি ভিক্ষুর মর্যাদা পায়—একজন 'সাধু বৃক্ষ' হয়ে ওঠে। বৌদ্ধ দেশে ভিক্ষুকে আঘাত করা যেমন গুরুতর পাপ, তেমনি দীক্ষিত গাছ কাটাকেও মানুষ ভয় পায়। তাই আমরা এই দীক্ষা রীতি চালু করেছি। এটা খুবই কার্যকর," বলেন তিনি।
বৃক্ষ দীক্ষার সূচনা
১৯৮০-এর দশকে উত্তর থাইল্যান্ডে ব্যাপক বন নিধনের সময় কিছু ভিক্ষু বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষার নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে এই সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করেন।
১৯৬১ সালে থাইল্যান্ডের মোট ভূমির ৫৩ শতাংশ ছিল বনভূমি, যা ১৯৮৬ সালের মধ্যে কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৫ শতাংশে—রাজকীয় বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী। সেই সময় দেশটি ছিল এশিয়ায় নেপালের পর সর্বোচ্চ হারে বন হারানো দেশ।
যদিও ১৯৮৯ সালে থাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লগিং নিষিদ্ধ করে, এরপরও বন উজাড় বন্ধ হয়নি। রাবার ও ক্যাসাভা চাষের জন্য প্রাচীন বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার 'সবুজ জ্বালানি' প্রকল্পের নাম করে খনি ও উইন্ড ফার্ম স্থাপন করা হচ্ছে, যার ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালেই প্রায় ৬,২০০ হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে, গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী।
'বনভিক্ষু'রা মনে করেন—বড় আকারের কৃষি খামার, জবরদখল, শহরায়ন, খনি প্রকল্প এবং অবৈধ কাঠ কাটা—এসবই থাইল্যান্ডের বন নিধনের মূল কারণ।
"আমরা বিদ্যুৎ চাই, রাস্তা চাই। আধুনিকতার জন্য প্রকৃতিকে কিছুটা ব্যবহার করতেই হয়। কিন্তু কতটা ব্যবহার করা হবে, সেটিই প্রশ্ন," বলেন দীর্ঘদিন বন সংরক্ষণের পক্ষে সোচ্চার ওয়াত পাসুকাটো মঠের অধ্যক্ষ ভেনারেবল পাইসাল ভিসালো। "আমার মনে হয় থাইল্যান্ডে এই ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ নেই।"
গাছ দীক্ষার রীতি শুরু করেন ভেনারেবল মানস নাথিপিতাক, ১৯৮৮ সালে। প্রথমে তিনি বন ও জল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ধর্মোপদেশ দিতেন, কিন্তু তার বক্তব্যে মানুষের আচরণে পরিবর্তন আসছিল না। ধর্মীয় পূণ্যলাভের আশায় অনেকে ওয়াজ শুনতে আসলেও পরে ফিরে গিয়ে আবারও বন কেটে জমি চাষ করত।
তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মানুষকে থামাতে হলে ধর্মীয় রীতিকে আরও দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাই ভিক্ষু দীক্ষার প্রচলিত রীতিকে অনুসরণ করে তিনি গাছের দীক্ষা শুরু করেন।
এই রীতি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এবং ১৯৯৬ সালে থাই সরকার এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। রাজা ভূমিবল আদুল্যাদেজের রাজ্যাভিষেকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বড় পরিসরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গাছ দীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কাও অনুরূপ রীতি চালু করেছে।
এই তৃণমূল উদ্যোগের ফলে থাইল্যান্ডে বনাঞ্চলের পরিমাণ কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০ শতকের শেষের দিকে যেখানে বনভূমি কমে ২৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল, সেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বেড়ে ৩৮ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৩৮.৮ শতাংশ ভূমি এখনো বনভূমি।
২০২৪ সালে কাজেটসার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোমচাই প্রসারতের একটি গবেষণা জার্নাল অফ ফিলোসফি কালচার এন্ড রিলিজিয়ন-এ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, 'থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ নীতিশিক্ষা পরিবেশ সংরক্ষণকে উৎসাহ দেয়।' গবেষণায় আরও বলা হয়, বৌদ্ধ নীতি মানুষকে টেকসই আচরণে উদ্বুদ্ধ করে এবং প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়ায়।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা