স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে পাঁচ বছরের জন্য ১৬,৭৩৮ কোটি টাকার কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে সরকার

সেক্টরভিত্তিক কর্মসূচি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে এসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সারাদেশের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা ও টিকাসামগ্রী সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ১৫,১২৩ কোটি টাকার একটি সমন্বিত কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র।
এছাড়া, বাতিল হওয়া পঞ্চম স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির (এইচএনপিএসপি) অংশ হিসেবে অবকাঠামো উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে দুই বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে।
এই দুই প্রকল্প মিলিয়ে ১৬,৭৩৮ কোটি টাকার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা ২৭ বছর ধরে চলা বিদেশি সহায়তাপুষ্ট স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি (এইচএনপিএসপি)-এর স্থলাভিষিক্ত হবে।
এইচএনপিএসপির চতুর্থ পর্যায় ২০২৪ সালের জুনে শেষ হয় এবং পঞ্চম পর্যায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার অনুমোদিত বাজেট নিয়ে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য গৃহীত হলেও তা পরবর্তীতে বাতিল করে দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তবে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পঞ্চম এইচএনপিএসপি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়নে দেখা গেছে—এই কর্মসূচির খাতভিত্তিক বাজেট পদ্ধতি কার্যকর হয়নি; বরং এতে কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি, ওভারল্যাপিং এবং সম্পদের অপচয় ঘটেছে।
এর পরিবর্তে মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেট একসঙ্গে সমন্বয় করে দেশব্যাপী গ্রামীণ ও শহুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আরও কার্যকর ও সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সেক্টরভিত্তিক কর্মসূচির আওতায় অনেক ক্ষেত্রেই একই ধরণের কাজ পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত থাকায় কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ও ওভারল্যাপিং হয়েছে, যার ফলে অর্থ ও সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থারও সৃষ্টি হয়। এ কারণে আমরা সেক্টর কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছি।"
তিনি বলেন, "এখন থেকে কয়েকটি পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আমরা আশা করছি, চলতি জুলাই মাসেই সব ব্রিজিং প্রকল্প অনুমোদন পাবে।"
প্রস্তাবিত 'হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিসেস ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেম স্ট্রেনথেনিং' প্রকল্পের আওতায় মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পুষ্টি, টিকাদান, অসংক্রামক রোগ শনাক্তকরণ এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো ও সেবার মানোন্নয়ন করা হবে।
এছাড়া একটি নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরির কাজও চলছে, যার আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
এরইমধ্যে প্রথম দুটি প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, খুব শিগগিরই এগুলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা জোরদারে বড় প্রকল্প
'হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভিসেস ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেম স্ট্রেনথেনিং' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুষ্টি, টিকাদান, অসংক্রামক রোগ নির্ণয়, ওষুধ সরবরাহ, রেফারেল ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করা হবে।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫,১২৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৮,৬৬৪ কোটি টাকা সরকারি অর্থায়ন এবং ৬,৪৫৯ কোটি টাকা আসবে বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ সহায়তা থেকে।
সব বিভাগে কার্যক্রম বিস্তার লাভ করলেও শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
প্রকল্পে ওষুধ, টিকা ও মেডিকেল সরঞ্জাম কেনায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থ।
প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নকাল হবে জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৯ পর্যন্ত।
অসমাপ্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে গৃহীত প্রকল্প
সরকার অনুমোদিত পঞ্চম এইচএনপিএসপি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিকল্প হিসেবে ১,৬১৫ কোটি টাকার একটি ব্রিজিং প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে দেশের ৬৪টি জেলার উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকার স্বাস্থ্যকাঠামো উন্নয়ন, আসবাব সরবরাহ, মানবসম্পদ ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় ৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় এবং আরও ৬টিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হবে। ৭টি পুরাতন কমপ্লেক্স পুনর্নির্মাণ ও ৭টি বিভাগীয় কার্যালয় নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের জন্য শুরু হওয়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) সম্প্রসারণ এবং এর কার্যকারিতা মূল্যায়নে গবেষণাও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত।
প্রকল্পে অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ৮৫৪.৭৫ কোটি টাকা এবং আসবাবপত্র ক্রয়ে ৫৯৮.৮১ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া জমি অধিগ্রহণ, বৈদ্যুতিক ও অফিস সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্যও বাজেট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়েছে জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৬ পর্যন্ত।