ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে তুরস্কে লোকগল্প সংরক্ষণের উদ্যোগ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। কাফ-দাগী নামের বিশাল পর্বতের ধারে ছিল এক রাজত্ব। সে রাজত্বে ইঁদুর করত নাপিতের কাজ। কচ্ছপের কাজ ছিল রুটি বানানো আর গাধাকে একাই সারাদিন চিঠিপত্র নিয়ে ডাকপিয়নের মতো ছুটে বেড়াতে হত। আজ আমরা যে মধ্যপ্রাচ্যকে চিনি তার অধিকাংশ কল্পকাহিনীর জন্ম কাফ-দাগী পার্শ্ববর্তী এই অলীক জগতে।
আজকের দিনে কাফ-দাগী খুঁজতে হলে যেতে হবে ককেশাস পর্বতমালায়। ক্যাসপিয়ান সাগর থেকে যেখানে কৃষ্ণ সাগর আলাদা হয়েছে সেখানেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে এই পর্বত। আরবীতে এই অঞ্চলটি জাবাল কাফ নামেই পরিচিত, অন্যদিকে ফার্সিতে এর নাম কোহ-কাফ। কোহ-কাফ সেই কল্পনার নগর যেখানে ডাইনির শাপে রাজকুমারেরা হয়ে যেত হরিণ শাবক। কমলা থেকে জন্ম নিত অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা। পরী আর ইফরিত দানবের সেই রাজত্বে সুলতান থেকে গোলাম আর কৃষক সবাইকে থাকতে হত তটস্থ।
আনাতোলিয়ান মালভূমির এই কল্পকাহিনীগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য আর সাহিত্য ক্ষুরধার দুইয়ে মিলে এক অপূর্ব সমন্বয়ের সৃষ্টি করেছে। আরব্য রজনী আর গ্রিম ভাইদের রূপকথা ছাড়াও কুর্দিশ, স্ল্যাভনিক, ঈহুদি আর রোমানিয়ান সংস্কৃতি ও গল্পগাঁথার ছোঁয়া পাওয়া যাবে গল্পগুলোতে। হাঙ্গারিয়ান তুর্কি বিশেষজ্ঞ ইগনাটুইস কুনোস ১৮৮০ সালে এসব কাহিনী সংগ্রহ শুরু করেন। কুনোসের মতে তুর্কির এই রূপকথা গুলো সাহিত্যের মহাসড়কে দামী পাথরের মতো অবহেলায় পড়ে আছে। সমঝদার কেউ তাদের কুড়িয়ে নিবে এখন শুধু সেই অপেক্ষা।
আধুনিকতাকে কুনোস ভয় পেয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল সময়ের সাথে আনাতোলিয়ার এই ঐতিহ্য পুরোপুরি মুছে যাবে। কিন্তু আশার কথা হল আজ একশ বছর পরেও গল্প বলার এই ঐতিহ্য টিকে আছে। বর্তমানে তুরস্কে 'মাসাল' নামের একটি বৃহৎ প্রজেক্টের মাধ্যমে দশ হাজার গল্প সংগ্রহ ও পুনর্লিখনের কাজ চলছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুর্কি রূপকথা পৌঁছে দিতেই উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়েছে।
তুরস্কের যেকোনো প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ হতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষক ও সাহিত্য অনুরাগীরা মাসালের অনলাইন পোর্টালে লোকগল্প জমা দিতে পারেন। এরপর গল্পগুলো তিনটি পর্যায়ে গবেষক এবং ভাষা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরীক্ষিত হয়। আতাতুর্ক কালচারাল সেন্টারের গৃহীত এই প্রজেক্টটির মাধ্যমে তুরস্কে প্রথমবারের মতো লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গল্পগুলোকে উৎপত্তি অনুযায়ী সাতটি অঞ্চল ভেদে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। কাহিনী অনুযায়ী রূপকথাগুলো প্রাণী, কাল্পনিক ও অবাস্তব, সত্য ঘটনা এবং রম্য গল্প এই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। জিনযেরলেমেলি গল্পগুলো একটি সুনিদির্ষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে। অনেকটা কবিতার মতো গল্পগুলোতে চরিত্র এবং ঘটনা আয়নার মতো প্রতিবিম্ব তৈরি করে।
অনেক সময় দেখা যায় একই কাহিনীর কয়েকটি রূপ আছে। অঞ্চলভেদে সময়ের সাথে গল্পগুলো যে রূপ পরিবর্তন করে তা সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য ঠিকমতো তথ্যসূত্র যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে। যেমন, তিন তিন কাবাক নামক এতিম দুই বোনের গল্পেরই অন্তত বিশটি ভার্সন পাওয়া যায়।
কোনো গল্প একবার গৃহীত হলে তা মাসালের ডেটাবেজের অংশ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত ৭৭ টি ভিন্ন উৎস থেকে তিন হাজার তিনশটি গল্প সংগৃহীত হয়েছে যার মধ্যে কুর্দিশ, লাজ, আরমেনিয়ান, সারসাসিয়ান ভাষার বিভিন্ন গল্প ও কবিতা আছে। গল্পগুলোকে তুর্কি ভাষায় অনূদিত করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যেই প্রজেক্টটি সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গল্পগুলোতে অসাধারন সব কাহিনী উঠে এসেছে। কখনো কথা বলা পশুপাখির দেখা মিলেছে, কখনো বা দেখা গেছে দানব থেকে শুরু করে ড্রাগনের মতো চরিত্রের উপস্থিতি। ফিনিক্স পাখির মতো পারস্যের এই রূপকথায় দেখা মিলবে পরোপকারী জুমরুতু আঙ্কা কিংবা সিমুরঘ পাখির।
তবে এতসব রঙিন কাহিনীরও আছে এক কদর্য রূপ। প্রায়ই মুর ও কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের দেখা মিলে গল্পগুলোতে। অধিকাংশ সময় তাদের দেখানো হয় নেতিবাচক চরিত্রে। অন্যদিকে অনেক গল্পে ঈহুদি নারীদের চিত্রায়িত করা হয়েছে ভয়ংকর ডাইনি রূপে। বিভৎস কাহিনীও আছে এর মাঝে। নির্দোষ নারীদের পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা কিংবা বন্য ঘোড়ার হিংস্রতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শত্রুদের পরিণতি যে কাউকে শিহরিত করবে।
তবে তুর্কি রূপকথার রাজনৈতিক একটি দিকও আছে। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসার পরই অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট লোক-সংস্কৃতি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। লোকগল্প পাঠের প্রবর্তক তুর্কি স্কলার পারতেভ নাইলি বোরাতভ চল্লিশের দশকে তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের রোষের মুখে পড়েন। জাতিগত ও বর্ণ বৈচিত্রের কাহিনীগুলো জাতীয়তাবাদীরা তুর্কি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মানতে বরাবরই অস্বীকার করে।
লেখক কায়া জেঙ্ক তার বই দা লায়ন অ্যান্ড দা নাইটিংগেল –এ তুর্কির এই বিপরীতধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করেন। বোরাতভের প্রশংসা করে তিনি বলেন, তাঁর নির্ভুল প্রজ্ঞা এবং সাহসী বুদ্ধিবৃত্তি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। জেঙ্ক আরও বলেন, 'লোককথার নায়কেরা মূলত ভিনদেশি হয়ে থাকে। স্বৈরাচারী রাজাদের জন্য তারা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়।' গল্পগুলো তাই গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে।
মুগলা স্মৃতি কোচমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ডক্টর মেহমেত নাসি ওনাল মাসালের একজন গবেষক। তিনি আশা করেন লেখক, গবেষক এবং সাহিত্যিকরা মিলিতভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে গল্পগুলো পৌঁছে দিতে সফল হবে। মেহমেতের ভাষায়-
'রূপকথা আমাদের কল্পনা করতে শেখায়। যুক্তিবাদী, ধৈর্যশীল, পরিশ্রমী এবং ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে। আমাদের শেখায় কীভাবে দুষ্টের বিরুদ্ধে সৎ সাহস রেখে লড়াই করে যেতে হয়। একই সাথে মিথ্যা, ছল ও কপটতাকে চিহ্নিত করার শিক্ষাও দেয়। এই মূল্যবোধগুলো সর্বজনীন। সময় বদলালেও মানবিক মূল্যবোধ একই রূপে থাকে।'
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা