অভিবাসন অভিযান: ক্যালিফোর্নিয়ায় কৃষিজমিতে শ্রমিক সংকট, মাঠে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে ফসল

ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনচুরা কাউন্টিতে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ফল ও সবজি উৎপাদিত হয়। এসব ফল-সবজির বেশিরভাগই উৎপাদন ও তোলার কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী অভিবাসীরা।
এ অঞ্চলের ষষ্ঠ প্রজন্মের কৃষক লিসা টেট বলছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির কঠোর প্রয়োগের অংশ হিসেবে এ মাসের শুরুতে অত্র এলাকার জমিগুলোতে ইউ.এস. ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) এজেন্টদের অভিযানে শ্রমিকরা ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমার মতে, মাঠের ৭০ শতাংশ শ্রমিকই উধাও হয়ে গেছেন। আপনার ৭০ শতাংশ কর্মী যদি কাজে না আসে, তবে ৭০ শতাংশ ফসলও তোলা হয় না। সেগুলো একদিনেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বেশিরভাগ আমেরিকান এই কাজ করতে চায় না। এখানকার অধিকাংশ কৃষকই কোনোমতে টিকে আছেন। এ অবস্থায় অনেকেই দেউলিয়া হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করছি।'
লস অ্যাঞ্জেলেসের উত্তরে ভেনচুরা কাউন্টি থেকে শুরু করে রাজ্যের সেন্ট্রাল ভ্যালি পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল কৃষি অঞ্চলে রয়টার্সের সঙ্গে কথা হয় দুজন কৃষক, দুজন খামার তত্ত্বাবধায়ক ও চারজন অভিবাসী কৃষি শ্রমিকের। তারা বলেন, আইসিইর অভিযানের ফলে অধিকাংশ শ্রমিক কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
তারা বলেন, এর ফলে ফসল তোলা হচ্ছে না—একেবারে ভরা মৌসুমে ফল ও সবজি মাঠেই পচে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেক্সিকান খামার তত্ত্বাবধায়ক গত সপ্তাহে তিনি স্ট্রবেরি চাষের জন্য প্রস্তুত করা একটি মাঠের কাজ তদারকি করছিলেন। বলেন জানান, সাধারণত তার স্ট্রবেরি খেতে ৩০০ শ্রমিক থাকেন। কিন্তু সেদিন ছিলেন মাত্র ৮০ জন। অন্য একটি খামারের আরেকজন তত্ত্বাবধায়ক জানান, তার জমিতে সাধারণত ৮০ জন কর্মী কাজ করেন, কিন্তু এখন আছেন মাত্র ১৭ জন।
বড় ক্ষতি
অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি শ্রমিকদের অনেকেই অবৈধভাবে সেদেশে বসবাস করছেন। তবে তারা এ-ও বলছেন, তাদের সংখ্যা হঠাৎ করে কমে গেলে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ও কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।
রিপাবলিকান পার্টির সদস্য ও কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের সাবেক পরিচালক ডগলাস হোল্টজ-ইকিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি শ্রমিক বিদেশি বংশোদ্ভূত, যাদের প্রায় অর্ধেকই দেশটিতে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাদের হারালে ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

হোল্টজ-ইকিন বলেন, 'এটা কৃষিশিল্প ও সরবরাহ চেইনের জন্য ক্ষতিকর।'
ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ সবজি ও তিন-চতুর্থাংশ ফল এবং বাদাম ক্যালিফোর্নিয়ায় উৎপাদিত হয়। ২০২৩ সালে এই রাজ্যের খামারগুলো থেকে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের কৃষি পণ্য বিক্রি হয়েছে।
রয়টার্স যে চারজন অভিবাসী কৃষি শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের মধ্যে দুজন অবৈধভাবে দেশটিতে বাস করছেন। আইসিইর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে এই দুজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
তাদেরই একজন ৫৪ বছর বয়সি শ্রমিক। তিনি গত ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাতে কাজ করছেন, তার স্ত্রী-সন্তানরা এখানেই থাকেন। তিনি জানান, তার বেশিরভাগ সহকর্মীই এখন আর কাজে আসছেন না।
তিনি বলেন, 'কাজে যোগ দিলে পরিবারের সঙ্গে আবার দেখা হবে কি না, তা তারা জানেন না।'
অবৈধভাবে বসবাসকারী অন্য একজন শ্রমিক রয়টার্সকে বলেন, 'আমাদের সকালের শুরুটাই হয় ভয় নিয়ে। আগে দুশ্চিন্তা ছিল রোদ আর গরম নিয়ে, কিন্তু এখন এর চেয়েও বড় সমস্যা যোগ হয়েছে—অনেকেই আর বাড়ি ফিরতে পারছে না। আমি রাস্তায় কোনো ঝামেলায় না জড়ানোর চেষ্টা করি। এখন যেকোনো কারণেই হোক, কাউকে গ্রেপ্তার করা হলেই দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।'
খামার শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি কমিউনিটি গ্রুপ বলেছে, অভিযানের পরও পেটের দায়ে অনেক শ্রমিক মাঠে ফিরছেন।

পাঁচটি গ্রুপ রয়টার্সকে জানিয়েছে, অভিযানের পরের কয়েকদিন মাঠে উপস্থিতি কম থাকলেও আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় শ্রমিকরা দ্রুতই কাজে ফিরে আসেন।
গ্রুপগুলো জানায়, অভিবাসন এজেন্টদের চোখ এড়াতে শ্রমিকরা আরও কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন। যেমন, বৈধ কাগজপত্র আছে এমন লোকের সঙ্গে একসাথে গাড়িতে যাতায়াত করা বা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এমন সন্তানকে মুদি দোকানে পাঠানো।
আইসিই আতঙ্ক
সম্প্রতি ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টের এক পোস্টে স্বীকার করেছেন, খামার শ্রমিক—এবং হোটেল কর্মীদের ওপর—আইসিইর অভিযান এই খাতগুলো থেকে 'খুব ভালো ও পুরোনো কর্মীদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে' এবং তাদের শূন্যস্থান 'পূরণ করা প্রায় অসম্ভব'।
পরে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের খুব ভালো কর্মী আছে।' তিনি আরও বলেন, 'তারা নাগরিক নয়, কিন্তু তারা চমৎকার কর্মী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।'
এই প্রভাব মোকাবিলায় তিনি একটি আদেশ জারির প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও কোনো নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়নি।
আইসিইর অভিযানের প্রভাব সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র অ্যানা কেলি বলেন, ট্রাম্প সবসময় কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। 'তিনি আমাদের অভিবাসন আইন প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার পাশাপাশি আমাদের কৃষি শিল্পকে শক্তিশালী করতে এবং রপ্তানি বাড়াতে কাজ করে যাবেন।'
অর্থনীতিবিদ বার্নার্ড ইয়ারোস এক প্রতিবেদনে বলেন, অভিবাসী শ্রমিকরা চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা স্থানীয় কর্মীদের দিয়ে সাধারণত পূরণ করা যায় না।
সেন্ট্রাল ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষক গ্রেগ টেশ বলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষিজমিতে আইসিইর অভিযান বৈধ কর্মীদেরও আতঙ্কিত করছে।