ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘বিগ, বিউটিফুল’ বাণিজ্য চুক্তি কি ভেস্তে যাচ্ছে?

৯ জুলাইয়ের নির্ধারিত সময়সীমা যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার 'বিগ, বিউটিফুল' বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই চুক্তিটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও, দুই দেশের মধ্যে কঠিন দরকষাকষিতে প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে পড়েছে। খবর বিবিসি'র।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলাইন লিভিট বলেছিলেন, চুক্তি খুব শিগগিরই হবে। আর ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, দিল্লি 'একটা বড়, ভালো ও সুন্দর' (বিগ, বিউটিফুল) চুক্তিকে স্বাগত জানাবে।
এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, দিল্লির সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি হতে যাচ্ছে এবং তা ভারতীয় বাজার 'খুলে দেবে'। তবুও মূল আলোচনায় কৃষিপণ্য, গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং ভারতীয় ইস্পাতের ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে মতবিরোধ কাটছে না।
ভারতের বাণিজ্য কর্মকর্তারা নতুন আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে আরও কয়েকদিন অবস্থান করবেন। দিল্লি কৃষি ও দুগ্ধপণ্য সুরক্ষায় 'বড় বাধা' উল্লেখ করলেও, আমেরিকা ভারতীয় বাজার আরও খুলতে চাপ দিচ্ছে। আলোচনার পরিবেশ ইতিবাচক থাকলেও চুক্তির সুযোগ কমতে শুরু করেছে।
ভারতের সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা ও গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, পরবর্তী সাত দিন নির্ধারণ করে দেবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সীমিত 'মিনি-চুক্তি'তে পৌঁছাবে, নাকি আলোচনা ভেঙে পড়বে।
এই অনিশ্চয়তা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় কৃষি।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিচার্ড রসো বলেন, 'প্রাথমিক চুক্তি সম্পন্ন করার দুইটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকার জন্য ভারতের বাজারে মৌলিক কৃষি পণ্যের প্রবেশাধিকার। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারতকে নিজের কৃষি খাত সুরক্ষিত রাখতে হবে।'
কয়েক বছর ধরে ওয়াশিংটন ভারতের কৃষি খাতে বেশি প্রবেশাধিকার চাইছে, কারণ এটাকে বড় একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে। কিন্তু ভারত এটিকে সুরক্ষিত রেখেছে, কারণ তারা খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকা ও লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র কৃষকের স্বার্থের কথা বলে।
রসো বলেন, 'দ্বিতীয় সমস্যা হলো ভারতের ট্যারিফবিহীন বাধাসমূহ। ভারতের বাড়তে থাকা কোয়ালিটি কন্ট্রোল অর্ডার (কিউসিও) মার্কিন বাজারে প্রবেশে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে এবং এগুলো একটি বাণিজ্য চুক্তিতে মোকাবেলা করা কঠিন হতে পারে।'
আমেরিকা ভারতের কঠোর ও বাড়তে থাকা আমদানি গুণগত মানের নিয়ম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। 'স্বনির্ভর ভারত' উদ্যোগের অংশ হিসেবে ৭০০ এর বেশি কিউসিও রয়েছে, যা নিম্নমানের আমদানি কমিয়ে দেশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এসেছে।
ভারতের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগের জ্যেষ্ঠ সদস্য সুমন বেরি এই নিয়মগুলোকে 'ক্ষতিকর হস্তক্ষেপ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা আমদানি সীমিত করে এবং দেশের মাঝারি ও ছোটো শিল্পের খরচ বাড়ায়।
ভারত-আমেরিকা কৃষি বাণিজ্য থাকলেও তা সীমিত মাত্রার। ভারতের কৃষি রপ্তানি প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ধান, চিংড়ি ও মসলা রয়েছে। আমেরিকা থেকে আসে বাদাম, আপেল ও মসুর ডাল। তবে চলমান বাণিজ্য আলোচনায় ওয়াশিংটন বড় ধরনের কৃষি পণ্য রপ্তানি—যেমন সয়াবিন, তুলা ও ভুট্টা চাচ্ছে, যাতে ভারতের সঙ্গে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে ভারতের কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) ও সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা দুর্বল হতে পারে। এগুলো কৃষকদের বাজারে দাম কমে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
নীতি আয়োগের কর্মকর্তা শ্রীবাস্তব বলেন, 'দুধ ও প্রধান খাদ্যশস্য যেমন ধান ও গমের ওপর শুল্ক কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই, কারণ এগুলো কৃষকদের জীবিকা ও দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষ এতে সংশ্লিষ্ট।'
অদ্ভুত হলেও, সম্প্রতি নীতি আয়োগের একটি রিপোর্টে আমেরিকার কৃষি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাব এসেছে। এতে ধান, দুগ্ধ, মুরগির মাংস, কর্ন (ভুট্টা), আপেল, বাদাম ও জিএম সয়াবিনের নাম রয়েছে। তবে স্পষ্ট নয়, এই প্রস্তাব সরকারিভাবে মেনে নেয়া হয়েছে কি না।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ রসো বলেন, যদি আমেরিকা বলে, 'আপনি মৌলিক কৃষিতে প্রবেশাধিকার না দিলে চুক্তি হবে না', তাহলে বুঝতে হবে তাদের প্রত্যাশা সঠিক ছিল না। যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার বাণিজ্য নীতিতে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা রাখে।
তাহলে এখন চুক্তির পরিস্থিতি কী হতে পারে?
শ্রীবাস্তবসহ অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, 'সম্ভাব্য চুক্তি হবে সীমিত আকারের'—যেমন মেরিল্যান্ডের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মে মাসের মিনি বাণিজ্য চুক্তি।
এই প্রস্তাবিত চুক্তিতে ভারত হয়তো কিছু শিল্পপণ্য যেমন গাড়ির ওপর শুল্ক কমাবে, যা আমেরিকার পুরোনো দাবি। পাশাপাশি কিছু কৃষিপণ্যে শুল্ক কমানো ও কোটার মাধ্যমে সীমিত প্রবেশাধিকার দেবে, যেমন ইথানল, বাদাম, আখরোট, আপেল, কিশমিশ, অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল, মদ ও ওয়াইন।
শুল্ক কমানোর বাইরেও আমেরিকা ভারতের কাছ থেকে বড় পরিসরে বাণিজ্য চায়—তেল, এলএনজি, বোয়িং বিমান, হেলিকপ্টার ও নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরসহ। এছাড়া আমেরিকার বড় রিটেইল বিক্রেতা অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের সুবিধার জন্য বহুমুখী রিটেইল বাণিজ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করার কথাও বলা হচ্ছে। আগে থেকেই প্রস্তুত করা পণ্যের নিয়ম শিথিল করার দাবিও রয়েছে।
শ্রীবাস্তব বলেন, 'এই মিনি চুক্তি হলে শুল্ক হ্রাস ও কৌশলগত প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব দেয়া হবে। বৃহত্তর ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) যেমন সেবা বাণিজ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অধিকার ও ডিজিটাল নিয়মকানুন পরবর্তীতে আলোচনা হবে।'
আলোচনার শুরুতে ট্রাম্প ও মোদি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, 'আমেরিকা মূলত পুঁজিবহুল পণ্য নিয়ে মনোযোগ দেবে, আর ভারত শ্রমনির্ভর পণ্যে।' তবে এরপর পরিস্থিতি বদলেছে।
চুক্তি ভেঙে গেলে ট্রাম্পের ২৬ শতাংশ শুল্ক পুনরায় বসানোর সম্ভাবনা কম। বরং অধিকাংশ ভারতীয় পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক বসতে পারে, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সর্বনিম্ন শুল্কের ওপর বাড়তি।
এপ্রিল মাসে ৫৭টি দেশ এই শুল্কের সম্মুখীন হয়েছিল, তবে এখন পর্যন্ত শুধু যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ভারতের ওপর বিশেষ শুল্ক চাপানো অনুচিত মনে হতে পারে। তবে শ্রীবাস্তবের মতে, 'ট্রাম্পের সময় বিস্মিত হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ই থাকে।'