জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে: ইরানের প্রেসিডেন্ট

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ওপর থেকে ইরানের বিশ্বাস উঠে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান। রোববার সন্ধ্যায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে ফোনালাপে এই মন্তব্য করেন তিনি। একই সময়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসির প্রতি সমর্থন জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।
ইরানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানা ১২ দিনের বিমানযুদ্ধে ইরানের প্রাণহানি বেড়ে ৯৩৫ জনে পৌঁছেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ৩৮ শিশু ও ১৩২ নারী।
ফোনালাপে পেজেশকিয়ান অভিযোগ করেন, গ্রোসি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেননি, যদিও তা জাতিসংঘ সনদ ও পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সরাসরি লঙ্ঘন। তবে তার ভাষা ইরানের অন্যদের তুলনায় অনেক সংযত ছিল, কারণ ইরানের কট্টরপন্থী সংবাদপত্র 'কায়হান' বলেছে—গ্রোসি ইরানে এলে তাকে মোসাদ-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, 'আমরা গ্রোসিকে হুমকির ঘটনায় নিন্দা জানাই এবং সংস্থার কার্যক্রম ও সেটির প্রতি পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করি।'
ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছে, 'আইএইএর সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখুন। আমরা চাই, ইরান তাদের আইনগত বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সহযোগিতা অবিলম্বে পূর্ণমাত্রায় শুরু করুক এবং সংস্থার কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।'
তবে ইরানে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী আচরণ নিয়ে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। দেশটি এখন আইএইএকে পরমাণু স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি যাচাইয়ের স্বাধীন সুযোগ না দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
ফোনালাপে পেজেশকিয়ান মাখোঁকে বলেন, 'আমরা যদি সহযোগিতাও করি, তাহলে কী গ্যারান্টি আছে যে ভবিষ্যতে আমাদের স্থাপনাগুলো আবার হামলার শিকার হবে না?' তিনি আরও জানতে চান, 'ইসরায়েল এনপিটির সদস্য নয়, তবুও কীভাবে তারা আইএইএর প্রতিবেদনের উৎস হতে পারে?'
এদিকে ওমানের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পর্দার পেছনে আলোচনার খবর এলেও, ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তখত-রাভানচি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো সময় বা তারিখ নির্ধারিত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ যে আপোসের প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাতে বলা হয়েছে—ইরান 'কিশ দ্বীপে' একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের আওতায় অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিতভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। এটি ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট আয়োজিত এক সেমিনারে সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত নিকোলাস হপটন বলেন, 'ইরানি শাসনব্যবস্থার অনেক ক্ষতি হয়েছে, তবে ইসরায়েলের মূল লক্ষ্যগুলো আদৌ অর্জিত হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিন সপ্তাহ আগেও এমন কোনো তথ্য ছিল না যে, ইরান দ্রুত পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে। অথচ এখন বলা হচ্ছে, ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আইএইএ এখনই নির্ভরযোগ্যভাবে বলতে পারবে না, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কতটুকু ক্ষতি হয়েছে। তা জানতে অনেক সময় লাগবে।'
ইরানের ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি আনসারি বলেন, 'এখন যে জাতীয়তাবাদী সংহতির কথা বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা মিইয়ে যাবে। সরকার বলছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় বিজয় অর্জন করেছে। এটি ঠিক জর্জ অরওয়েলের সেই বক্তব্যের মতো—যেখানে তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদ মানে বাস্তবতা থেকে উদাসীনতা।'
আনসারি আরও বলেন, 'বাস্তবতা হলো—রাষ্ট্রের ভেতরেই এখন তীব্র আলোচনা চলছে, কী ভুল হয়েছে তা নিয়ে। আকাশ প্রতিরক্ষা, বেসামরিক প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরের গভীর অনুপ্রবেশ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। মানুষ এখন বলছে, আমরা তো ভেবেছিলাম ইসলামি প্রজাতন্ত্র অন্তত আমাদের রক্ষা করতে পারবে, কিন্তু সেটা তো করতে পারছে না। যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র এই সংঘাতে জড়িয়েছে, সেটা আর আগের মতো থাকবে না।'