কনটেইনার জটে অচল চট্টগ্রাম বন্দর ও আইসিডিগুলো, আটকে আছে রপ্তানির ১৫ হাজার কনটেইনার

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর ও এর ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে বড় ধরনের কনটেইনার জটের সৃষ্টি কনটেইনার।
সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার রপ্তানি কনটেইনার আইসিডিগুলোতে আটকা পড়ে আছে। বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজারেরও বেশি, যা বন্দরের আদর্শ ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। কর্মকর্তাদের ধারণা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
জাহাজ ছাড়তে দেরি, কনটেইনার ওঠানো যায়নি
২৯ জুন চারটি কনটেইনার জাহাজ নির্ধারিত সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়তে পারেনি, কারণ আইসিডিগুলো থেকে রপ্তানি কনটেইনার পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। এসব জাহাজে প্রায় ৩ হাজার কনটেইনার (রপ্তানি ও খালি) ওঠানো সম্ভব হয়নি।
৩০ জুনের মধ্যে পূর্বের বিলম্বিত জাহাজসহ পাঁচটি জাহাজ সিঙ্গাপুর, কলম্বোসহ বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। তবে চলমান জটের কারণে প্রায় ৫০টি রপ্তানি কনটেইনার সময়মতো লোড করা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের এনসিটি টার্মিনাল ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন জানান, জাহাজ হং ডা ক্সিন ৬৮-এর জন্য নির্ধারিত ২টি রপ্তানি কনটেইনার এবং হং ইয়ং চান সেনএর জন্য ৩৯টি কনটেইনার লোড করা সম্ভব হয়নি। জাহাজগুলো এগুলো ছাড়াই বন্দর ছেড়ে গেছে।
মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানির তথ্যমতে, তাদের কনটেইনার জাহাজ এএস সিসিলিকা ২৪৩টি রপ্তানি কনটেইনার লোড করতে পারেনি এবং ২৯ জুন জিসিবি টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যেতে পারেনি। পরে ৩০ জুন দুপুরে জাহাজটি সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, তবে তখনও ৩টি রপ্তানি কনটেইনার লোড করা সম্ভব হয়নি।
৩০ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙরে ২০টি জাহাজ জেটিতে আসার অপেক্ষায় ছিল। এর মধ্যে ১১টি গিয়ারলেস এবং ৯টি গিয়ার্ড জাহাজ, কিছু জাহাজ ৬ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। শিপিং কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, প্রতিদিন প্রতিটি জাহাজের জন্য অপেক্ষার খরচ ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার ডলার, যা শেষ পর্যন্ত রপ্তানিকারকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে।
আইসিডিগুলোতে অতিরিক্ত চাপ
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইসিডিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত আইসিডিগুলোতে ৮ হাজার টিইইউ (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার একক) রপ্তানি কনটেইনার রাখা হয় এবং প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ২২০০ টিইইউ বন্দর এলাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু ২৫ জুন শুরু হওয়া শাটডাউনের কারণে এই সংখ্যা বেড়ে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ৯৪৬ টিইইউতে পৌঁছেছে।
বিআইসিডিএ-র মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার জানান, রোববার রাতে আইসিডিগুলোতে কাস্টমস কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে এবং সোমবার সকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৮১৭ টিইইউ চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'কনটেইনার জট কমাতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগবে, তবে জাহাজের সময়সূচি অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।'
১৯টি আইসিডির মোট ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৬ হাজার ২০০ টিইইউ। এর মধ্যে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮২ হাজার ৫৬ টিইইউ দখল করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৮ হাজার ৪৭৬ টিইইউ খালি কনটেইনার।
চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে জট
বন্দর ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউ হলেও স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য প্রায় ৩৫ হাজার টিইইউ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ৩০ জুন পর্যন্ত বন্দরে ৪১ হাজার ৪৩২ টিইইউ কনটেইনার রাখা হয়েছে, যা ২৫ জুনের ৩৭ হাজার ৩৮৩ টিইইউ থেকে পাঁচ দিনে ৪ হাজার ৪৯ টিইইউ বেশি।
শাটডাউন চলাকালে কনটেইনার ডেলিভারি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়: ২৮ জুন মাত্র ১৩৯ টিইইউ এবং ২৯ জুন ৭৭৪ টিইইউ ছাড়া হয়। সাধারণত প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টিইইউ ডেলিভারি হয়। গত দুই দিনে মাত্র ৯১৩ টিইইউ ছাড়া হয়েছে — যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ৮ হাজার টিইইউ ছাড়া হতো।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, 'বন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, সোমবার থেকে কনটেইনার ডেলিভারি স্বাভাবিক হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে জট কমে যাবে বলে আশা করছি।'
কাস্টমস কার্যক্রম শুরু
এনবিআর কর্মকর্তারা রোববার রাতে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর বন্দর ও আইসিডিগুলোতে কাস্টমস কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের বিল অব এন্ট্রি প্রসেসিং ও কাস্টমস মূল্যায়ন পুরোপুরি চালু হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার সাইদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা দ্রুত বকেয়া আমদানি চালানের মূল্যায়ন শেষ করার চেষ্টা করছি এবং সোমবারের মধ্যে জট কমানোর আশা করছি।'
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য সরোয়ার আলম খান বলেন, এ বিলম্বে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমদানিকারকদের অতিরিক্ত ডেমারেজ চার্জ দিতে হচ্ছে এবং চার দিনের বেশি দেরি হলে স্টোরেজ ফি চার গুণ বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত অনেক ব্যবসায়ী কাস্টমস বন্ধ থাকার কারণে পণ্য ডেলিভারি নিতে পারেননি, এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।'