রাজস্ব ঘাটতি: ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংকঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে
দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগলেও রাজস্ব ঘাটতিতে পড়ে বাজেট চাহিদা মেটাতে ব্যাংকঋণের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। অর্থবছর শেষ হতে এখনও কয়েক দিন বাকি থাকলেও সরকার ইতিমধ্যে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জুন পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের ৯৯ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ১.২২ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২২ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা।
সরকারের ঋণ বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব আদায় ও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যাংকাররা।
তারা বলেন, অর্থবছরের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাপক খারাপ ছিল। এই সময়ে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ না করায় ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে রাজস্ব আদায় কম থাকায় সরকারও ব্যাংকগুলো থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সরকারের ব্যাংকঋণ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেল। এর আগে লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ নিয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে। সেবার ১.১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার ১.১৯ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।
অর্থবছরের মাঝপথে এসে সরকার বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় বাড়তি শুল্ক-কর আরোপ করলেও তাতে রাজস্ব আদায়ে খুব একাটা সুফল মেলেনি।
এর আগে কিছু কিছু অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করেছে তার চেয়ে বেশি। সেই সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্রের মতো ব্যাংকিং-বহির্ভূত উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিতে হচ্ছে। কারণ ব্যাংকিং খাত ও বিদেশি উৎস ছাড়া সরকারের উপায় নেই। সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নেয়, আদায় তার চেয়ে কম। ঋণের মাধ্যমে এই ব্যবধান পূরণ করতে হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। মে মাস পর্যন্ত ৩.৯৪ লাখ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩.২৭ লাখ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতায় উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যে অর্থ দরকার, সে অনুযায়ী টাকা আসছে না, যার কারণে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ বেশি নিচ্ছে।'
'আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম, এটি বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে না পারলে তখন ক্রাউডিং আউট হবে। তখন ব্যক্তি খাতের ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। ব্যাংকিং খাতের ইতিমধ্যেই তারল্য সংকট রয়েছে,' বলেন তিনি।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করা, কর জাল বাড়ানো এবং অটোমেশন ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সতর্ক করে বলেন, ব্যাংক থেকে সরকারের এই অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ অর্থনীতির জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা।
'সরকার যখন ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল ঋণ নেয়, তখন ব্যাংকের হাতে তারল্য কমে যায়। এতে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ পাওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়,' বলেন তিনি।
এই ব্যাংকার আরও বলেন, 'এ পরিস্থিতি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত করে দেয়। এখন ব্যক্তি খাতের ঋণের চাহিদা কম, যার কারণে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পেরেছে ব্যাংকগুলো। সামনের দিনগুলোতে বেসরকারি খাতের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে না পারলে ক্রাউডিং-আউট সৃষ্টি হবে। একইসঙ্গে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাবে, মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।'
মাহবুবুর রহমান বলেন, 'বর্তমানে বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ মোট ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ। নতুন অর্থবছরেও সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়ালে বেসরকারি খাতে প্রভাব তৈরি হবে। এটি টেকসই উপায় নয়।'
