অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারের ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ বেশি
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ করেছে বেশি। এর ফলে এই সময়ে সরকারের নিট পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর কারণ সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়া ও ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার কমে যাওয়া। সুদহার কমার কারণে সরকারি ঋণে ব্যাংকগুলোর আগ্রহও কমে গেছে।
এর মধ্যে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৯০০ কোটি টাকা ও তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করেছে। তবে এই সময়ে ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস—যেমন ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী—থেকে ১২ হাজার ৫০১ কোটি টাকা ধার করেছে সরকার।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১.০৪ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম চার মাসে নিট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৮.৭১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে সরকারের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬.৩৩ লাখ কোটি টাকা, যা জুনে ছিল প্রায় ৭.৫৭ লাখ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বড় কোনো মেগা প্রকল্প না থাকায় ঋণের চাহিদা কমেছে। এছাড়া সার্বিক আমদানি কমে যাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই ঋণের চাহিদা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'নতুন সরকার গঠিত হলে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে, তখন সরকারের ঋণগ্রহণও বাড়বে।'
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২.৩৮ লাখ কোটি টাকা। তবে প্রথম তিন মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা বার্ষিক লক্ষ্যের মাত্র ৫ শতাংশ।
একজন ব্যাংকার বলেন, 'আমদানি কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণচাহিদাও অনেক কমেছে। সরকার যখন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বাড়ায় না, তখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও কম আমদানি করে, ফলে বাণিজ্যিক ঋণের চাহিদা কমে যায়।'
ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস থেকে ঋণ বাড়ল কেন?
সরকার সাধারণ ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে বড় একটি অংশ নেয় তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে; কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ কম কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের ঋণের চাহিদা কম থাকা এবং ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস থেকে ঋণ নেওয়া।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বেশ কিছু বিমা কোম্পানি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ এই সময়ে বেশি হয়েছে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্রামীণফোন, বিকাশসহ বেশি কিছু প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিল-বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করছে। এছাড়া বিসিবিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা এখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমরা এখন ঋণ নেওয়ার জন্য যে অকশন করি, তফসিলি ব্যাংকগুলো সেখানে যে রেট চাচ্ছে তারচেয়ে কম রেটে নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো বিট দাখিল করছে—যার কারণে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ কম।'
গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর মুনাফার বড় একটি অংশই এসেছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে। ওই অর্থবছরে পুরো সময়ে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ছিল ১২ শতাংশের বেশি। এখন সুদহার অনেকটা কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। এতে তফসিলি ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কমেছে, বেসরকারি খাতেও ঋণের প্রবাহে গতি নেই।
বেসরকারি খাতে ঋণ চার বছরের সর্বনিম্ন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সেপ্টেম্বরে ৬.২৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। আগস্টে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৩৫ শতাংশ, জুলাইয়ে ৬.৫২ শতাংশ, জুনে ৬.৪০ শতাংশ, মে মাসে ৭.১৭ শতাংশ ও এপ্রিলে ৭.৫ শতাংশ।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই মন্দা আশ্চর্যজনক নয়। তিনি বলেন, 'সামগ্রিক বিনিয়োগ ধীরগতিতে চলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ধীর হওয়ায় অভ্যন্তরীণ ভোগ দুর্বল। আমদানি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় বাণিজ্য ঋণের চাহিদাও কম। এটি একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়, যা বিশেষ করে উৎপাদন ও সেবা খাতকে প্রভাবিত করছে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলতে পারে।'
মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স শক্তিশালী থাকলেও মূলধনী যন্ত্রপাতি—বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও স্পিনিং খাতের—আমদানি কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, 'ঋণের চাহিদা কম থাকায়, উদ্বৃত্ত তারল্য থাকা ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করছে, যা তাদের সুদ আয় কমিয়ে দিচ্ছে। অতিরিক্ত তারল্য ও তারল্য সংকট দুটোই এই খাতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।'
