ইসরায়েলে ইরানের ফাত্তাহ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: এটি কি যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে সক্ষম?

ইসরায়েলের ওপর প্রথমবারের মতো গত ১৮ জুন নিজস্ব প্রযুক্তিতে উন্নয়নকৃত হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র 'ফাত্তাহ' ব্যবহার করে ইরান। ঐদিন ভোরে চালানো এই হামলার খবর জানিয়েছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)। তারা জানায়, ইসরায়েলের বহুস্তরবিশিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে ম্যাক ১৩ গতির এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
'অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি'-এর অংশ হিসেবে এটি ছিল ইরানের একাদশ দফার পাল্টা হামলা। এর আগে ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনার ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালালে পাল্টা হামলা শুরু করে তেহরান। এরপর থেকে উভয় দেশের মধ্যে একাধিক পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে।
আইআরজিসি দাবি করেছে, 'ফাত্তাহ' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে 'ইসরায়েলের কাল্পনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার অবসান শুরু হয়েছে।' বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, 'শক্তিশালী ও অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার রাতে ভীতু জায়োনিস্টদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বারবার কাঁপিয়ে দিয়েছে। তেলআবিবের যুদ্ধবাজ মিত্রদের উদ্দেশে এটি ইরানের শক্তির স্পষ্ট বার্তা, যারা এখনো বিভ্রম ও ভ্রান্ত ধারণায় বাস করছে।'
২০২৩ সালের জুনে উন্মোচিত এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। ইরানি সূত্রমতে, এটি একটি হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) বহন করে ম্যাক ১৩ থেকে ১৫ পর্যন্ত চূড়ান্ত গতিতে পৌঁছাতে সক্ষম। এই গতির সঙ্গে উচ্চ মাত্রার গতিপথ পরিবর্তনের ক্ষমতা একে প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব করে তোলে।
বিশ্বে প্রথম রাশিয়া এই ধরনের গ্লাইড ভেহিকল যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে। পরে চীন ও উত্তর কোরিয়াও হাইপারসনিক গ্লাইড প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র চালু করে এবং ইরান সর্বশেষ এতে যোগ দেয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর কোরিয়া 'হোয়াসং-৮' নামের একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়, যার পাল্লা আনুমানিক ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। তখন থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, পিয়ংইয়ং এই প্রযুক্তি দ্রুত ইরানকেও সরবরাহ করতে পারে।
উল্লেখ্য, ১৯৮০-এর দশকে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকেই ইরান তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সূচনা করে। এরপর কয়েক দশক ধরে প্রযুক্তি, যন্ত্রাংশ ও অভিজ্ঞতা পেয়ে আসছে তারা।
ইয়েমেন থেকে উৎক্ষেপণ করা তুলনামূলক 'নিম্নমানের' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতেই হিমশিম খাচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এরই মধ্যে ফাত্তাহের মতো উন্নত শ্রেণির অস্ত্র ব্যবহারের ফলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা কাঠামোর দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল হচ্ছে আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্যবস্তু।
তবে ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্রের একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো, এতে পারমাণবিক বা রাসায়নিক ওয়ারহেড নেই। ফলে একক হামলায় সীমিত ক্ষতি সাধন করতে পারে। আরও একটি প্রশ্ন হলো—ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা এবং তা উৎপাদনে কতটা ব্যয়সাপেক্ষ।
এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের একটি কৌশল হতে পারে ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে আঘাত হানা। এতে করে অন্যান্য নিম্নমানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সহজেই ঢুকে পড়তে পারবে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে।
ইতিমধ্যেই ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাফল্যের হার পশ্চিমাদের মূল্যায়নের তুলনায় অনেক বেশি। এবং ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা অস্ত্রের মজুত ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাওয়ায়, এই সাফল্যের হার আরও বাড়তে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের অ্যারো, বারাক ৮ ও ডেভিডস স্লিং-এর মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম হলেও, এগুলো ইরানের দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার জন্য তেমন কার্যকর নয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর থাড ও ইসরায়েল ঘেঁষে অবস্থানরত মার্কিন নৌবাহিনীর এইজিস ডেস্ট্রয়ার থেকে আংশিক সহায়তা পেলেও তা যথেষ্ট নয়।
ফাত্তাহ এখন পর্যন্ত ইরানের সামরিক শক্তির অন্যতম প্রধান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রকৃত প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে এটির নিখুঁত আঘাত হানার ক্ষমতা, কী ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ইরানের কাছে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কতটা—এই কয়েকটি বিষয়ে।
যদি ইরান সত্যিই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে এবং ঘোষিত সক্ষমতা অনুযায়ী এটি কার্যকর হয়, তবে কেবল চলমান যুদ্ধেই নয়, সারা বিশ্বে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপযোগিতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।