ইউক্রেনে শান্তি প্রচেষ্টা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের অন্তর্দ্বন্দ্ব ফাঁস

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে চলমান শান্তি আলোচনায়— ওয়াশিংটনের কিছু প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইউক্রেন এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তারা এই সপ্তাহে পাল্টা অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের হাতে আসা প্রস্তাবনাগুলোর পূর্ণ পাঠ্য এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গত ১৭ এপ্রিল প্যারিস এবং ২৩ এপ্রিল লন্ডনে অনুষ্ঠিত মার্কিন, ইউরোপীয় এবং ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের বৈঠকের আলোচনাপত্রগুলো শান্তি প্রচেষ্টার অভ্যন্তরীণ কৌশল স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত যুদ্ধের সমাপ্তি চাইছেন।
কিন্তু দুই সেট প্রস্তাবনার মধ্যে মূল পার্থক্য দেখা গেছে—ভূখণ্ড ইস্যুর সমাধানের ধাপ, রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার সংক্রান্ত বিষয়ে।
যদিও আলোচনার সাথে যুক্ত সূত্রগুলো আগে কিছু বিভেদের আভাস দিয়েছিল, তবে এবারই প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ ও সুস্পষ্টভাবে এসব ভিন্নতা প্রকাশ পেল।
প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, "উভয়পক্ষের জন্য (রাশিয়া ও ইউক্রন) এই শর্তাবলী-ই যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রস্তাব।" ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ প্রথমে এই প্রস্তাব প্যারিসে ইউরোপীয় দেশগুলোর কর্মকর্তাদের দেন, পরে সেটি ইউক্রেনীয়দের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় বলে সূত্র জানায়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই প্রস্তাবনাগুলোকে একটি 'বিস্তৃত কাঠামো' হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা ভিন্নমতগুলো শনাক্ত করবে। তবে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স পরে জানান, "আমরা খুবই স্পষ্টভাবে প্রস্তাব দিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়—অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার শান্তি প্রচেষ্টা থেকে সরে দাঁড়াবে।"
এদিকে লন্ডনে ইউক্রেনীয় ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের বৈঠক থেকে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় প্রস্তাবনাটি তৈরি হয়, যা পরে মার্কিন প্রতিনিধিদের দেয়া হয়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বৃহস্পতিবার জানান, লন্ডনের আলোচনার পর তৈরি হওয়া প্রস্তাবনা এখন ট্রাম্পের টেবিলে রয়েছে।
এরপর শুক্রবার ট্রাম্পের দূত উইটকফ মস্কো পৌঁছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
রাশিয়ার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। তারপর থেকে এপর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধে এটিই সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। বর্তমানে মস্কো ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে।
যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য
ভূখণ্ড ইস্যুতে, উইটকফের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্রিমিয়া অঞ্চল (যা ২০১৪ সালে রাশিয়া দখল করেছিল) রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলোকেও অঘোষিত স্বীকৃতির ইঙ্গিত রয়েছে।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ও ইউক্রেনীয় যৌথ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, "যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরই ভূখণ্ড ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা হবে।" কোনো অবস্থাতেই রাশিয়ার দখলকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা সেখানে উল্লেখ করা হয়নি।
ক্রিমিয়া ইস্যুতে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায় যখন ট্রাম্প টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গেই থাকবে," এবং ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন।
নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে উইটকফের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইউক্রেন ইউরোপীয় এবং অন্যান্য মিত্র দেশের কাছ থেকে "মজবুত নিরাপত্তা গ্যারান্টি" পাবে, তবে ন্যাটোতে যোগ দেবে না।
অন্যদিকে ইউক্রেনীয় ও ইউরোপীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের সামরিক শক্তির ওপর কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না এবং ইউক্রেনের মাটিতে মিত্র দেশগুলোর সেনা মোতায়েনেও কোনো বাধা থাকবে না। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য মিত্রদের "ন্যাটো আর্টিকেল ৫-এর মতো প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা" দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
অর্থনৈতিক বিষয়ে উইটকফের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, "২০১৪ সাল থেকে আরোপিত রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে তুলে নেয়া হবে।"
কিন্তু ইউরোপের পাল্টা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, "টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার পর ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে, তবে রাশিয়া যদি চুক্তি লঙ্ঘন করে, নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হবে।"
সেইসঙ্গে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিদেশে জব্দকৃত সম্পদ থেকে অর্থ দেয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে, যেখানে উইটকফের প্রস্তাবে শুধু "আর্থিক ক্ষতিপূরণের" কথা থাকলেও— কোন উৎস থেকে তা দেওয়া হবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি।
চাপ ও উদ্বেগ
কিয়েভ এবং মস্কো—উভয় পক্ষই ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টা বজায় রাখার জন্য নিজেদের পক্ষ থেকে অগ্রগতি দেখাতে চেষ্টা করছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি দিয়েছে আলোচনায় অগ্রগতি না হলে তারা উদ্যোগ বন্ধ করে দেবে।
জেলেনস্কি বলেন, "লন্ডনের আলোচনা সহজ ছিল না, তবে গঠনমূলক ছিল।"
এদিকে তিনজন ইউরোপীয় কূটনীতিক রয়টার্সকে জানান, "প্রথমে প্যারিসের আলোচনা ফলপ্রসূ মনে হলেও— পরবর্তী কয়েকদিনে মার্কিন পক্ষ থেকে চুক্তির জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে, যা ইউরোপীয় ও ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।"
তাদের মতে, লন্ডনের বৈঠক ব্যবহার করা হয়েছে ইউরোপীয়-ইউক্রেনীয় পাল্টা প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করতে, যা মার্কিন প্রতিনিধি কিথ কেলগ ওয়াশিংটনে নিয়ে গেছেন।