৩০০ বছর ধরে সমাধিস্থ, তবুও এ সম্রাট কেন আজ লাখো মানুষের ক্ষোভের কারণ?

৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে মারা গেলেও এক ভারতীয় শাসক এখনও দেশটির রাজনীতিতে আলোড়ন তুলছেন।
ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওরঙ্গজেব আলমগীর এমনভাবে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন যে, তার স্মৃতিকে ঘিরে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
মোগল সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ সম্রাট হিসেবে পরিচিত আওরঙ্গজেবকে অনেকেই কঠোর ও দমনমূলক শাসক বলে মনে করেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি নারীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছেন, হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন, মানুষকে জোর করে ধর্মান্তর করেছেন এবং হিন্দু ও শিখ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
আজকের ভারতে, যেখানে রাজনীতির আবহ অনেকটাই হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে, সেখানে আওরঙ্গজেবের এ 'অপরাধগুলো' ডানপন্থী নেতাদের কাছে একধরনের রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে। তাকে মুসলিম 'খলনায়ক' হিসেবে চিত্রিত করে বলা হচ্ছে, তার স্মৃতিচিহ্নগুলো মুছে ফেলা দরকার।
গত মাসে মধ্য ভারতের নাগপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আওরঙ্গাবাদে আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের আহ্বান জানান কিছু কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী।
সম্প্রতি এক বলিউড সিনেমায় একজন প্রখ্যাত হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সহিংস বিজয়ের চিত্র দেখানো হলে উত্তেজনা আরও ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ আহত ও গ্রেপ্তার হন, এবং নাগপুরে কারফিউ জারি করতে হয়।
দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে চলার মাঝে অনেক ডানপন্থী হিন্দু আওরঙ্গজেবের নাম ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিরুদ্ধে অতীতের অবিচারের কথা তুলছেন।
এর ফলে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের মধ্যে উদ্বেগ ও ভয়ের আবহ ছড়িয়ে পড়ছে।
'প্রশংসা এবং বিদ্বেষ'
মোগলরা এমন এক সময়ে শাসন করেছেন, যা ছিল বিজয়, দখল এবং সহিংস ক্ষমতার লড়াইয়ের যুগ। কিন্তু একই সঙ্গে এটি ছিল শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের সময়—অন্তত আওরঙ্গজেবের আগ পর্যন্ত।
১৫২৬ সালে বাবর মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। একসময় এ সাম্রাজ্য আধুনিক আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পূর্বে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশরা শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে অপসারণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়।

মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে স্মরণীয় শাসকরা—হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান—ধর্মীয় সহনশীলতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তাজমহল ও লাল কেল্লার মতো স্থাপনার মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতিতে গভীর ছাপ রেখেছেন।
কিন্তু এ সহনশীলতার ধারার মধ্যেই আওরঙ্গজেব ছিলেন ব্যতিক্রম—একজন কঠোর ধর্মীয় বিশ্বাসী এবং জটিল ব্যক্তিত্বের শাসক।
'মোগল সিংহাসনে বসার প্রথম দিন থেকেই আওরঙ্গজেব প্রশংসা ও ঘৃণার মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিলেন,' বলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার (বার্কলি) পারস্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ অভিষেক কাইকার।
'তিনি তার বাবাকে বন্দি করেছিলেন এবং ভাইদের হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন—এটি অনেকের চোখে তাকে বিতর্কিত করে তোলে... একই সঙ্গে, তার বিনয়ী জীবনযাপন, গভীর ধর্মবিশ্বাস, অসাধারণ সামরিক শক্তি, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং ন্যায়পরায়ণতাও প্রশংসিত হয়েছে।'
১৬১৮ সালে আওরঙ্গজেব জন্মগ্রহণ করেন সম্রাট শাহজাহান (তাজমহলের নির্মাতা) এবং মমতাজ মহলের (যার স্মৃতিতে তাজমহল নির্মিত) ঘরে। ইতিহাসবিদরা তাকে একজন গম্ভীর ও ধর্মপরায়ণ তরুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যিনি তরুণ বয়স থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি দেখিয়েছিলেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আওরঙ্গজেব গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষ নেতার মতো নিজেকে প্রমাণ করেন। শাহজাহানের আমলে মোগল সাম্রাজ্য চূড়ায় পৌঁছায় এবং আওরঙ্গজেব বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন।
তাই ১৬৫৭ সালে শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আওরঙ্গজেব ও তার তিন ভাইবোনের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হয়। এ সংঘাদে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বড় ভাই দারা শিকো ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিলনের পক্ষে।
১৬৫৮ সালে আওরঙ্গজেব তার অসুস্থ বাবাকে বন্দি করেন এবং পরের বছর দারাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপর দিল্লির রাস্তায় দারাকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় একটি নোংরা হাতির পিঠে তুলে জনসমক্ষে ঘুরিয়ে দেখান।
পরে দারা শিকোকে হত্যা করা হয়।
হঠাৎ পরিবর্তন
ক্ষমতা দখলের পর এক সময় আওরঙ্গজেব তার ক্ষমতার শিখরে পৌঁছান এবং তার শাসনামলে মোগল সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে সর্বাধিক বিস্তৃত হয়।
তাকে একসময় শ্রদ্ধার চোখেও দেখা হতো। শাসনের প্রথমদিকে তিনি কঠোর শাসনের পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রতি তুলনামূলকভাবে সহনশীল মনোভাব রাখতেন।

ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক নাদিম রেজাভির মতে, প্রায় ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত মন্দির ভাঙা বা অমুসলিম প্রজাদের ওপর জিজিয়া কর আরোপের কোনো নজির পাওয়া যায় না। তার ভাষ্য অনুযায়ী, আওরঙ্গজেব ছিলেন 'তার পূর্বপুরুষদের মতোই'। রেজাভি বলেন, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে অনেক হিন্দু উচ্চ পদে আসীন ছিলেন।
তবে ১৬৮০ সাল থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ওই সময় তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার একটি প্রবণতা গ্রহণ করেন, যার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায়।
এ গোঁড়া শাসক তার মন্ত্রিসভার হিন্দু সদস্যদের পদাবনতি দেন, বন্ধুদের শত্রুতে পরিণত করেন এবং দাক্ষিণাত্যে এক দীর্ঘ ও অজনপ্রিয় যুদ্ধ শুরু করেন—যার অংশ হিসেবে মারাঠাদের ওপর সহিংস দমন চালানো হয়। এ হিন্দু রাজ্যটিকে আজকের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ডানপন্থী রাজনীতিকেরা সম্মানের চোখে দেখেন।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা আওরঙ্গজেবের শাসনামলে জোরপূর্বক ধর্মান্তর, জিজিয়া কর পুনর্বহাল এবং অমুসলিমদের হত্যা করার মতো হিন্দুদের ওপর সংঘটিত নিষ্ঠুরতার বিভিন্ন বিষয় বর্তমানে তুলে ধরছেন।
শুধু হিন্দুদের নয়, আওরঙ্গজেব শিখদের ওপরও আক্রমণ চালিয়েছিলেন। তিনি শিখদের নবম গুরু তেগ বাহাদুরকে হত্যার নির্দেশ দেন, যার কারণে আজও অনেক শিখের কাছে আওরঙ্গজেব ঘৃণার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া 'ছাভা' চলচ্চিত্রেও এসব নির্মমতা চিত্রিত হয়েছে। সেখানে আওরঙ্গজেবকে উপস্থাপন করা হয়েছে এক বর্বর ইসলামপন্থী শাসক হিসেবে, যিনি মারাঠা সম্রাট ছত্রপতি শিবাজির পুত্র শম্ভাজিকে হত্যা করেছেন।
'ছাভা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে জনরোষের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে,' বলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। উল্লেখ্য, এ প্রদেশেই অবস্থিত নাগপুর।
মুসলিমদের অভিযোগ, সম্প্রতি ডানপন্থী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএচপি) কিছু সদস্য পবিত্র কোরআনের আয়াতসমৃদ্ধ একটি লেখা পুড়িয়ে দিয়েছেন।
ভিএচপির সদস্য যজেন্দ্র ঠাকুর এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে তিনি আওরঙ্গজেবের সমাধি অপসারণের দাবিকে সমর্থন করেছেন।
নাগপুরে সিএনএন-কে তিনি বলেন, 'আওরঙ্গজেবের সমাধি এখানে থাকা উচিত নয়। শম্ভাজি মহারাজের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তার ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এমনকি আমাদের মুসলিম ভাইদেরও এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া উচিত যে, আওরঙ্গজেবের সমাধি নাগপুরে থাকা অনুচিত।'

'প্রশংসাও নয়, দোষও নয়'
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘদিন ধরে তার ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর দীর্ঘদিনের সদস্য—ডানপন্থী এ আধাসামরিক সংগঠন ভারতের ভেতরে হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে। তাদের মতে, ভারতের হিন্দুরা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হয়েছে—প্রথমে মোগলদের হাতে, পরে ব্রিটিশদের শাসনকালেও।
মহারাষ্ট্রের যে জেলায় আওরঙ্গজেব সমাধিস্থ হয়েছিলেন, তার নাম একসময় ছিল 'আওরঙ্গাবাদ'। ২০২৩ সালে নাম পরিবর্তন করে তা রাখা হয় ছত্রপতি শিবাজির পুত্র শম্ভাজির নামে। রেজাভি বলেন, আওরঙ্গজেবের পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবর ও শাহজাহানের বিজয়ের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়েছে, কিংবা এখন আর স্কুলে পড়ানো হয় না।
তিনি বলেন, 'তারা ইতিহাসকে পেছনে নিয়ে পৌরাণিক কাহিনির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করতে চাইছে, যা তাদের কল্পনার ফসল। একটি সম্প্রদায়কে দানবীয়ভাবে রূপ দিতে আওরঙ্গজেবকে ব্যবহার করা হচ্ছে।'
মোদির বিজেপি দাবি করে, তারা মুসলমানদের অপমান করার জন্য মোগল সম্রাটদের নাম টেনে আনে না। কিন্তু ভারতের অতীত শাসকদের হালের প্রসঙ্গ এখন দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আশঙ্কা ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
ইতিহাসবিদরা একমত যে, আওরঙ্গজেব ছিলেন এক জটিল ও বিতর্কিত চরিত্র এবং তার নিষ্ঠুরতা অস্বীকার করা যায় না। তবে রেজাভি মনে করেন, এসব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতও বিবেচনায় নিতে হবে—যখন 'ভারত ধারণা'র কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
'আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন কোনো সংবিধান ছিল না, সংসদ ছিল না, গণতন্ত্রও ছিল না,' বলেন রেজাভি।
ইতিহাসবিদ কায়কারও এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। তার মতে, 'এ ধরনের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরকে প্রশংসা বা দোষারোপের মানদণ্ডে বিচার করা উচিত নয়। তাদের মূল্যায়ন করতে হবে তাদের সময় ও প্রেক্ষাপটে—যা আমাদের বর্তমান সময় থেকে অনেক দূরের।'
নাগপুরে আওরঙ্গজেবের সমাধি অপসারণের দাবিতে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি কিছু হিন্দু কট্টরপন্থী সদস্যও সমাধি ধ্বংসের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন।
স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দা আসিফ কোরেশি বলেন, তার শহর এমন সহিংসতা এর আগে দেখেনি। তার ভাষ্য, 'গত মাসে যা ঘটেছে, তা আমাদের ঐতিহাসিকভাবে শান্তিপূর্ণ শহরের জন্য এক বড় কলঙ্ক।'