যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্কযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা বাড়াতে আগ্রহী জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলো

জার্মানির উচ্চপর্যায়ের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল এই মাসে বাংলাদেশ সফর করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করা।
প্রতিনিধিদলে জার্মান পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, দেশটির রপ্তানি ঋণ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা ছিলেন। তারা ঢাকায় অনুষ্ঠিত 'বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫'-এ অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন।
জার্মান এশিয়া-প্যাসিফিক বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন (ওএভি), যা এশিয়াজুড়ে জার্মান ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে, এই সফর সমন্বয় করেছে।
ওসপিগ জিএমবিএইচ-এর প্রধান নির্বাহী এবং প্রতিনিধিদলের সদস্য থমাস ক্যানিং বলেন, 'উদীয়মান বাজার হিসেবে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা সত্যিই প্রশংসনীয়। সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক সূচক ও অন্যান্য উপাদানগুলো আশাব্যঞ্জক মনে হয়েছে।'
ওএভি-র নির্বাহী বোর্ড সদস্য আলমুট র্যোসনার বলেন, সফরের উদ্দেশ্য ছিল 'জানাশোনা, তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ স্থাপন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। যাতে জার্মান কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের সংস্কার নীতি ও বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে হালনাগাদ এবং সঠিক তথ্য দেওয়া যায়।'
বাংলাদেশ-জার্মানি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক পরিস্থিতি
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও জার্মানির দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জার্মানি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই দেশে বাংলাদেশের রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি পণ্যই তৈরি পোশাক।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ জার্মানি থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে তার মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রী।
বাংলাদেশে বেশ কিছু জার্মান কোম্পানি কাজ করছে, বিশেষ করে পোশাক ও চামড়াজাত পণ্যের খাতে নিজেদের উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
প্রথম দিকের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একজন থমাস ক্যানিং–এর কোম্পানি ওসপিগ হাজার হাজার শ্রমিক নিয়ে মানসম্পন্ন জিনস ও জ্যাকেট উৎপাদন করে। আর পিকার্ড ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশে হ্যান্ডব্যাগ ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী তৈরি করছে।
জার্মানির বাইসাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কিউব এবং বাংলাদেশের মেঘনা গ্রুপ যৌথভাবে গঠন করেছে হানা সিস্টেম লিমিটেড, যেটি একটি সফল যৌথ উদ্যোগের উদাহরণ।
জার্মান এশিয়া-প্যাসিফিক বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন (ওএভি)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৮০টি জার্মান কোম্পানি বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে—যাদের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বিএএসএফ , বায়ার, বশ এবং সিমেন্স।
শুল্ক-উত্তেজনার মাঝে সম্ভাবনার খোঁজে বাংলাদেশ
জার্মান ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে এমন এক সময়ে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামো বদলের উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
চলতি বছরের ২ এপ্রিল ট্রাম্প বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপ করেন। যদিও অধিকাংশ বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য তিনি ৯০ দিনের ছাড় ঘোষণা করেছিলেন, তবুও নীতিগত এই ওঠানামা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও তাদের অর্ডারের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই আসে বস্ত্র ও পোশাক খাত থেকে। সম্প্রতি এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে গণ-আন্দোলনের ধাক্কা সামলে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিয়ম নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা করছে, তখন বাংলাদেশ সেই শূন্যস্থানকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ হিসেবে দেখছে; বিশেষত যারা চীনের বিকল্প দেখছে।
জার্মান ব্যবসায়ী থমাস ক্যানিং বলেন, 'ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন এবং চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক জার্মান কোম্পানিগুলোকে বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজতে বাধ্য করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বৈচিত্র্য আনয়ন এবং সাম্প্রতিক শুল্ক বিঘ্নের প্রেক্ষাপটে ভোক্তাপণ্য, ইলেকট্রনিকস, গৃহস্থালি সামগ্রী এবং শিল্পের বিভিন্ন উপাদান উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ চীনের বিকল্প হতে পারে।'
ক্যানিং বলেন, 'বাংলাদেশে ১১ কোটি ৪০ লাখ শ্রমশক্তি রয়েছে এবং মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার সমান। এটি বিশাল ব্যবসায়িক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।'
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ নামের থিংক ট্যাংকের প্রধান নির্বাহী এবং অর্থনীতিবিদ মাসরুর রেজাও এই ধারণার সঙ্গে একমত। তিনি বর্তমান পরিস্থিতিকে 'এক প্রজন্মে একবার আসে এমন সুযোগ' বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, 'এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পুরোনো নিয়ম সংশোধন, বাণিজ্য-সংক্রান্ত পরিবহণ সমস্যা দূরীকরণ এবং দক্ষতা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'আমরা যদি এখনই কাজে না নামি, তাহলে অন্যরা সুযোগটা নিয়ে নেবে।'
বিনিয়োগকারীরা এখনো সতর্ক
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পথে বড় বাধা হচ্ছে বিদ্যুৎ–সংকট, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ এবং দুর্নীতি।
জার্মান বিনিয়োগকারীরা এসব সমস্যার কথা জানেন। তবে থমাস ক্যানিং মনে করেন, এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
ক্যানিং বলেন, 'যদিও নানা বাধা রয়েছে, তবুও তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের সফলতা প্রমাণ করে—দেশটি অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও একই ধরনের অগ্রগতি অর্জন করতে পারে।'
তবুও অনেক বিনিয়োগকারী এখনো দ্বিধায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওএভি'র আলমুট র্যোসনার। তার মতে, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক রূপান্তর অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কার চালু ও নতুন নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে।
র্যোসনার বলেন, 'এশিয়া বা ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়েও সুযোগ কাজে লাগাতে আগ্রহী হলেও, জার্মান কোম্পানিগুলো এখনো অপেক্ষা করছে।'
বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ রিয়াজ বলেন, রাজনৈতিক রূপান্তর যত দ্রুত শেষ হবে, দেশের জন্য তত ভালো।
তার মতে, 'বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আসে। তারা একটি স্থিতিশীল সরকার চায়, যার হাতে জনগণের সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট থাকবে।'