যুক্তরাষ্ট্র সম্মান দেখালে আলোচনায় আপত্তি নেই চীনের, একজন প্রধান মুখপাত্র চায় বেইজিং

চীনা সরকারের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত একজন ব্যক্তির মতে, বাণিজ্য আলোচনা শুরু করতে সম্মত হওয়ার আগে চীন চায় ট্রাম্প প্রশাসন কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। এর মধ্যে রয়েছে ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্যদের অবমাননাকর মন্তব্য নিয়ন্ত্রণে এনে আরও সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা।
অভ্যন্তরীণ নীতিগত ভাবনার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, চীনের অন্যান্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে আরও ধারাবাহিক মার্কিন অবস্থান এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের উদ্বেগের প্রতি সদিচ্ছা প্রদর্শন।
তিনি আরও বলেন, বেইজিং চায় যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার জন্য এমন একজন প্রধান মুখপাত্র (পয়েন্ট পারসন) নিয়োগ করুক, যিনি প্রেসিডেন্টর পূর্ণ সমর্থন নিয়ে কাজ করবেন এবং ট্রাম্প ও চীনা নেতা শি জিনপিং-এর সম্ভাব্য বৈঠকে স্বাক্ষরের জন্য একটি চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে ভূমিকা রাখতে পারবেন।
বিশ্ব অর্থনীতি এবং আর্থিক বাজারের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পেতে পারে কি না তার ওপর। ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প অধিকাংশ চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে চীনকে চাপে ফেলেছেন, যার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বেইজিংও শুল্ক আরোপ করেছে এবং এতে বিশ্বের বৃহত্তম দুটি অর্থনীতির মধ্যকার বাণিজ্য প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
এ সংক্রান্ত খবরে অফশোর ইউয়ান ডলারের বিপরীতে ০.২ শতাংশ বেড়েছে। চীনের 'প্রক্সি কারেন্সি' হিসেবে বিবেচিত অস্ট্রেলিয়ান ডলারের মানও ০.৫ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের ফিউচার সেশনের শুরুতে প্রায় ১.৬ শতাংশ পতন দেখা গেছে।
মার্কিন শুল্ক আরোপের আক্রমণাত্মক অবস্থান চীনের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট আবারও চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা বাণিজ্য যুদ্ধ সমাধানের জন্য তার সঙ্গে আলোচনায় বসে।
আলোচনা কতদূর গড়াবে এবং কতটা অগ্রগতি হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। উভয় দেশই আলোচনার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে—ট্রাম্প নিজে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে, চীন চায় রাষ্ট্রনেতাদের যেকোনো আলাপ থেকে একটি স্পষ্ট ও কার্যকর ফলাফল বেরিয়ে আসুক।
তবে তারা আলোচনার প্রক্রিয়ায় একমত হলেও, শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তির রূপ কেমন হবে, সে মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়। ট্রাম্পের দাবিগুলো এখনও অস্পষ্ট, এবং তিনি চীনের ওপর শুল্ক বজায় রেখে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা ও মার্কিন শিল্পকারখানা ফেরত আনার লক্ষ্য পূরণ করতে চাইছেন।
'কঠিন' সামনের পথ
যদিও চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই অভ্যন্তরীণ চাপে শুল্ক কমাতে আগ্রহী হতে পারে, তবুও আলোচনার মাধ্যমে 'অর্থবহ উত্তেজনা হ্রাসের সম্ভাবনা কম'—বলেছেন সোসিয়েট জেনারেল এসএ-এর গ্রেটার চায়না অঞ্চলের অর্থনীতিবিদ মিশেল ল্যাম।
তিনি বলেন, 'চীন আসলে কী চাচ্ছে, সেটা এখন কিছুটা স্পষ্ট: সম্মান, ধারাবাহিকতা এবং একজন প্রধান মুখপাত্র। কাজেই বল এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে—তারা এ দাবি পূরণে সক্ষম কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তবে এটা কঠিনই হবে—বিশেষ করে যদি যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হয় চীনের উত্থানকে দমন করা।'
চীনা সরকারের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত ওই ব্যক্তির মতে, আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো, চীনা কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে, এ সংলাপ যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে পরিচালিত হবে।
তিনি আরও বলেন, যদিও ট্রাম্প শি জিনপিং সম্পর্কে প্রকাশ্যে তুলনামূলকভাবে সংযত থেকেছেন, তার প্রশাসনের অন্যান্য সদস্যরা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন, যা চীনের কর্মকর্তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পরিস্থিতি যেমনই থাক, বেইজিং এখন বিশ্বাস করে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর এটির ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তা চীন সম্পর্কে কিছু বললে এবং ট্রাম্প তা প্রকাশ্যে খণ্ডন না করলে চীন ধরে নেয়—প্রেসিডেন্ট সে অবস্থানকে সমর্থন করছেন।
পয়েন্ট পারসন
চীন চায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ—বিশেষ করে তাইওয়ান ইস্যু—সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিক। বেইজিং স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে এবং এ দাবি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিয়ে আসছে। ওই ব্যক্তি জানান, চীন তাইওয়ান ইস্যুতে কোনো উসকানিমূলক পদক্ষেপ নেবে না, তবে উসকানি পেলে প্রতিক্রিয়া জানাবে।
তিনি আরও বলেন, আলোচনার জন্য একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি বা মুখপাত্র নিয়োগ করুক যুক্তরাষ্ট্র—এটাও চীনের চাওয়া। প্রতিনিধি কে হবেন, সে বিষয়ে বেইজিংয়ের নির্দিষ্ট পছন্দ নেই; তবে চায় এমন কেউ আসুন, যিনি ট্রাম্পের প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং প্রেসিডেন্টর অনুমোদন নিয়েই কথা বলবেন।
ওই ব্যক্তি বলেন, চীনা কর্মকর্তারা এটাও বুঝতে পারছেন যে, ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে আলোচনার নেতৃত্ব দিতে চাইতে পারেন। ট্রাম্প নিজে আলোচনার জন্য সময় দিতে চাইলে বেইজিং তা স্বাগত জানাবে। তবে চীনের দৃষ্টিতে সবচেয়ে ফলপ্রসূ পদ্ধতি হবে—দুই প্রেসিডেন্টের মনোনীত কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় আলোচনা এগিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন, ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে অর্থবহ এক শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে আলোচনার একটি সফল পরিসমাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য এটিই সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।