রতন, জামাই-বউ, মধুবন: বিভিন্ন জেলার চানাচুর খেতে যেমন

"হরিদাসের বুলবুল ভাজা, হার মেনে যায় খুরমা-খাজা // কোথা লাগে পাঁপর ভাজা, গলদা চিংড়ি জিবে গজা!" হরিদাসের বুলবুল ভাজার যুগ পেরিয়েছে। এরপর বুলবুল ভাজার জায়গায় এসেছে চুরমুর, ডালমুঠ কিংবা চানাচুর। তবে, বুলবুল ভাজা না খেলেও চানাচুর খাননি এমন মানুষ এই মুলুকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
টক ঝাল মিষ্টি চানাচুরের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের সেই ছেলেবেলা, প্রথম স্কুলজীবন আর টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে জীবনের প্রথম বন্ধুদের সাথে ভাগ করে খেতে শেখবার গল্প। চানাচুরের একেকটা বাদাম, মটরশুটি, টক টক মুসুরডাল আর সেই চরম ঝাঁঝালো স্বাদ—আহা! লা জওয়াব। স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চানাচুরওয়ালা যেন স্বপ্নের মানুষ। ছোট্ট ঠোঙায় পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে চানাচুর মাখা খেতে খেতে যে বন্ধুত্ব, তা আর একটা আস্ত জীবনে কখনো তৈরি হয় না।
ছেলেবেলায় কারো বাড়ি বেড়াতে যাওয়া মানেই একটা প্রতীক্ষা। না, ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডের জন্য নয়। প্রতীক্ষা প্লেটভর্তি চানাচুর আসবার। চানাচুরের একেকটা মশলায় যেন একেকটা গল্প, স্মৃতি, ঝলমলে রঙ আর মানুষ উঁকিঝুঁকি দেয়। বাড়িতে মায়ের হাতের ঝাল তরকারি খেতে না পারলেও আমরা কিন্তু ঐ ঝাল ঝাল চানাচুর খেতে কেমন করে জানি শিখে যাই। ঐ বোধহয় প্রথম বড়ো হয়ে ওঠা।
নিজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে লুকিয়ে চানাচুর মাখা খাওয়ার মতন বীরত্ব সে বয়সে আর কতই বা আছে? দিন, মাস, বছর পেরোয়। স্কুলের উর্দিগুলো ওয়ার্ডরোবন্দি হয়। স্মৃতিতে মরচে পড়ে। তবু এক কোণে যত্নে বেঁচে থাকে চানাচুরের সাথে জড়িয়ে থাকা মুহূর্তরা।
টক-ঝাল-মিষ্টির তর্কগুলো কিন্তু বাক্সে আটকানো যায় না। না, স্বাদ, গন্ধ আর রসনা যদ্দিন বাঁচে, চানাচুর চিবোতে চিবোতে সেসব দিনও বাঁচে বহাল তবিয়তে। ব্যস্ততায় জীবন অন্যরকম হলেও কিছুতেই মরে না সেই চানাচুরপ্রেমী মনটা। চায়ের সঙ্গে 'টা' হিসেবে মুড়ি-চানাচুর নাহলে কোনো ঘরোয়া গেট টুগেদারের সন্ধ্যে বা বৃষ্টির বিকেল যেন কিছুতেই জমে না।

চানাচুরের সাথে যে বাঙালির কতখানি আবেগ মিশে আছে, তা লিখে কি বোঝানো সম্ভব?
বাংলাদেশের বাজারে যেসব ব্র্যান্ডের চানাচুর বেশ জনপ্রিয়, তারমধ্যে আছে রুচি ঝাল চানাচুর, রুচি বারবিকিউ চানাচুর, বোম্বে সুইটসের চানাচুর আর প্রাণের চানাচুর। কিন্তু এসব ব্র্যান্ডের বাইরে স্থানীয়পর্যায়ে এমন কিছু চানাচুরের জনপ্রিয়তা রয়েছে, যেসব ব্র্যান্ড জাতীয়পর্যায়ে অপরিচিত নাম। চানাচুরপ্রেমীদের সাথে গল্পে গল্পে জানা গেল স্থানীয় চানাচুরের ভিন্ন স্বাদের কথা।
রতন চানাচুর
সাতক্ষীরা জেলায় রতন চানাচুর একটা ব্র্যান্ড। রুচি, প্রাণ কিংবা বোম্বে সুইটসের চানাচুরের থেকে রতন চানাচুর দক্ষিণের এই জেলায় অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। স্থানীয় ব্র্যান্ড হিসেবে রতনের এই জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে, এই ঝাল ঝাল স্বাদ, মশলার বৈচিত্রতা ও গোটা রসুনের সংমিশ্রণ। ঝাল চানাচুরপ্রেমীরা রতন চানাচুরকে অন্য অনেক চানাচুর থেকে বেশ এগিয়েই রাখে।
তপন এবং হুগলি চানাচুর
"আমি তখন ছোট। বাগেরহাট জেলার মোংলায় তপন চানাচুরের খোলা প্যাকেট বিক্রি হতো চায়ের দোকানে। হাটের দিনে গ্রামের দিকে ২০০-২৫০ গ্রাম করে কিনে নিয়ে আসত মামা, কাকুরা। আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে ৫/১০ টাকার চানাচুর কিনতে যেতাম। খবরের কাগজে মুড়ে দিত ঝাল ঝাল তপন চানাচুর। এরপর সবাই মিলে ভাগ বাটোয়ারা করে খাওয়ার পালা। এত বেশি ঝাল ছিল যে চোখ দিয়ে জল গড়াতো। তবু খেতে অন্যরকমের ভালো লাগা কাজ করত। বড় হতে হতে এই চানাচুরের স্বাদে বদল এসেছে। এখন আর ঝালও অত নেই, বাদামও আগেরমতন থাকে না। আগের প্যাকেজিংও আলাদা ঘরোয়া স্টাইলের ছিলো। এখন কমার্শিয়াল। দামটাও বেড়েছে অনেক।"
তপন চানাচুর নিয়ে এসব কথা জানাচ্ছিলেন চানাচুরপ্রেমী জয়শ্রী।
রতন ও তপন চানাচুরের মালিক (সিদ্ধেশ্বর রায়) একই হলেও রতন চানাচুরের চল খুলনায় খুব একটা দেখা যায় না। খুলনা, বাগেরহাটের বাজার দখল করে আছে তপন চানাচুর। আবার কাছাকাছি জেলা হলেও সাতক্ষীরায় চল নেই তপন চানাচুরের। এছাড়া বাগেরহাটের হুগলি চানাচুরও বেশ জনপ্রিয় স্থানীয় ব্র্যান্ড। রসুনের আধিক্যের কারণে এটি চানাচুরপ্রেমীদের মন কেড়ে নেয়, সাথে ঝাল তো আছেই।

সাহাবুদ্দিনের মধুবন চানাচুর
সাহাবুদ্দিনের মধুবন চানাচুর একসময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী টক-ঝাল স্বাদের একটি জনপ্রিয় নাম, যা খুলনার গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খুলনা জেলার দৌলতপুর উপজেলার এসবি ফুড প্রোডাক্টসের তৈরি এই চানাচুরের স্বাদ বছরের পর বছর ধরে একই রয়ে গেছে। লাল-হলুদ রঙের ছোট্ট প্যাকেটে পাওয়া যাওয়া এই মুখরোচক চানাচুরের দাম একসময় মাত্র দুই টাকা ছিল, তবে এখন অবশ্য আর সে দাম নেই।
শহরের বড় দোকানে ব্র্যান্ডের চানাচুরের ভিড়ে মধুবনের জায়গা কমে গেলেও, মফস্বল ও গ্রামের মুদি কিংবা চায়ের দোকানগুলোতে এটি এখনও অবলীলায় পাওয়া যায়। অনেকেই বিদেশে গেলে সঙ্গে নিয়ে যান এই অনন্য স্বাদের চানাচুর। একসময় শিশুদের কাছে মধুবন ছিল চকলেটের মতোই আকর্ষণীয়। তবে বাড়িতে মেহমানের সামনের টেবিলে কখনো জায়গা পায়নি এ চানাচুরের।
স্কুল থেকে ফেরার পথে বা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ছোটরা দশ টাকা নিয়ে দোকানে ছুটে যেত, 'কাকু, একটা মধুবন!' বলে। ঝাল-মশলাদার স্বাদের কারণে এ চানাচুর একবার খাওয়া শুরু করলে থামা কঠিন—যেন ঝালমুড়ির মতো এক নিশ্বাসে পুরো প্যাকেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে। স্বাদের কারণে আজও অনেকেই এই চানাচুর দেখলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, হারিয়ে যান পুরোনো দিনের মিষ্টি স্মৃতিতে।
জামাই-বউ চানাচুর
নামটা যেমনি চটকদার, স্বাদও তেমনি। রাস্তায় রাস্তায় ভ্যানে করে ফেরি করে চানাচুরওয়ালারা এ চানাচুর বিক্রি করে থাকেন। চানাচুরের সাথে পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো, শসা, ধনেপাতাসহ বিশেষ কিছু মশলা মিশিয়ে এ চানাচুর মাখা প্রস্তুত করা হয়। বলে রাখা ভালো, জামাই-বউ চানাচুর খেতে পারবেন ব্যাচেলাররাও।
ঝাল ঝাল স্বাদের এই চানাচুরের জনপ্রিয়তা এখন আর আগের মতো না থাকলেও বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলোতে ২৫-৩০ বছর আগে থেকে এই চানাচুর চলে আসছে। স্কুল-কলেজের সামনে জামাই বউ চানাচুরের ভ্যান থাকত না এমন দিন ছিল না। অনেক চানাচুরের ভ্যানে আবার বাজতে থাকত ছায়াছবির গান।

জামাই-বউ চানাচুরের ভ্যানগুলো ইদানিং ঢাকার রাস্তায় দেখা যায়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে এ চানাচুর মাখা খাওয়ার মধ্যে রয়েছে আলাদা একটা ব্যাপার। কাগজের ওপর রেখে সদ্য মাখা চানাচুর খেতে খেতে আপনি হারিয়ে যাবেন আলাদা জগতে।
লাভলি চানাচুর
কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চলের এক জনপ্রিয় চানাচুর হচ্ছে লাভলি চানাচুর। অনেক বেশি বাদাম থাকায় এ চানাচুর চানাচুরপ্রেমীদের কাছে আলাদা চাহিদা ধরে রাখতে পেরেছে। সাধারণের তুলনায় খানিকটা ছোটো প্যাকেটে বিক্রি হওয়া এ চানাচুরের স্বাদ অতুলনীয়। ৯০-এর দশক থেকে চালু হওয়া এ চানাচুরের ব্র্যান্ড স্থানীয় ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত বাজার দখল করে রেখেছে।
"ঈদের সময় ঈদ সালামি পেয়ে ভাইবোন সবাই একসঙ্গে কয়েক প্যাকেট চানাচুর কিনত। তখন চানাচুরের দাম খুব বেশি ছিল না, ৫-১০ টাকা প্যাকেট। কয়েক প্যাকেট কিনে সে কাড়াকাড়ি চলতে থাকত।
"এছাড়া, কৌটায় ঢেলে রাখা চানাচুর একটু একটু করে খেতাম ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে। যেন কী মূল্যবান জিনিস! এই চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখা হলে সেদিনের সন্ধ্যা হত আলাদা আনন্দের। লাভলি চানাচুর এখন প্যাকেটের পাশাপাশি কৌটায় করেও বিক্রি হয়। যদিও আগের মতো স্বাদ নেই, তবু লাভলি চানাচুরের সাথে এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে এই চানাচুর কিনতেই ভালো লাগে।"
এভাবেই লাভলি চানাচুর নিয়ে নানা অনুভূতি ব্যক্ত করছিলেন মেহেরপুরের চানাচুরপ্রেমী আনহা আহমেদ।

গিরিধারী ও অন্বেষা চানাচুর
স্থানীয় ব্র্যান্ডের ঝাল চানাচুরের মধ্যে যদি অভিনব স্বাদের কোনো চানাচুর আপনি খেতে চান, তবে আপনাকে গিরিধারী চানাচুর খেতেই হবে। এই চানাচুর দিনাজপুর জেলায় বেশ বিখ্যাত নাম।
শুধু যে ঝাল তা কিন্তু নয়, মশলার এত দুরন্ত সংমিশ্রণ, যেন একটা শিল্প! এই চানাচুর খেলে আপনি এরপর আর কোনো ঝাল চানাচুর খেতেই চাইবেন না। শাদামাটা মিনি সাইজের প্যাকেটের এ চানাচুর দেখে প্রথমে যদিও প্রত্যাশা থাকবে শূন্য, কিন্তু একবার মুখে দিতেই মশলার মারপ্যাচে হারিয়ে যাবেন চানাচুরের জগতে।
তখনই মুখে পড়বে চিড়ে ভাজা আর বাদাম। আহা, কী স্বাদ! মনে হতেই থাকবে, এমন তো কখনো খাইনি! ঝাল ঝাল চানাচুরে চোখমুখ লাল হতে থাকবে, তবু নিবৃত্ত করতে পারবেন না আপনার রসনা।
অন্বেষা চানাচুরের কথা বললে — যারা জিলাপির সাথে ছোলা ভুনা খেতে ভালোবাসেন — তাদের জন্য অন্বেষা চানাচুর হবে সেরা। এছাড়াও, খুব বেশি ঝাল খেতে পারেন না অথচ চানাচুর ভালোবাসেন, এমন মানুষের জন্য অন্বেষা একটা দারুণ সংযোজনই বটে।
ঝালের ভাব থাকলেও একটা মিষ্টি মিষ্টি ব্যাপারও ধরে রাখা হয়েছে এ চানাচুরে। আর দুটো স্বাদের সংমিশ্রণ স্বাদকে নষ্ট না করে বরং দ্বিগুণ করে তুলেছে।
স্থানীয় চানাচুরের বৈচিত্র্য ও চ্যালেঞ্জ
রাজবাড়ি জেলার দিলবাহার চানাচুর, বগুড়া জেলার শ্যামলী চানাচুর, নীলফামারী জেলার গাউসিয়া চানাচুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয়ভিত্তিতে ছড়িয়ে আছে নানা চানাচুরের ব্র্যান্ড। প্রতিটির স্বাদে রয়েছে অনন্যতা, এলাকাভিত্তিক রুচির ছোঁয়া।

তবে এমন স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই স্বাস্থ্যবিধি না মানা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদনের অভিযোগ ওঠে। অনেক ব্র্যান্ডের বিএসটিআইয়ের অনুমোদনও নেই।
ভালো স্বাদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের দিক বিবেচনায় স্থানীয় চানাচুরের কারখানাগুলোর তদারকি বৃদ্ধি এই সম্ভাবনাময় চানাচুরের ব্র্যান্ডগুলোকে আনতে পারে মূলধারায়। জাতীয় ভিত্তিতে বাজারজাতকরণের জন্য যে মানোন্নয়ন প্রয়োজন, সেদিকেও নজর দেওয়া আবশ্যক।
ফেরি করে চানাচুর বিক্রি করা সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা হারাতে বসেছে। কারণ চানাচুর বিক্রির ঐ টাকায় সংসার চলে না। পেটের দায়ে বিকল্প পেশার কথা ভাবতেই হয়। কেউ কেউ অন্য কাজের পাশে একটা নির্দিষ্ট সময় চানাচুর বিক্রি করেন।
নব্বই দশকের ছেলেবেলায় প্যাকেট চানাচুরের প্রতি যে অন্যরকম আবেগ ছিল, তা আজকের দিনের শিশুদের মধ্যে দেখা যায় না। চানাচুরের জায়গা নিয়েছে পিজ্জা, বার্গারের মতো খাবার।
তবু চানাচুরের বিকল্প হিসেবে এসব খাবার বেশ দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির পরিবারে, মফস্বল আর গ্রামেগঞ্জে চানাচুরের সেই জায়গা কিন্তু হারায়নি। ভাত-ডাল-মাছ যতখানি বাঙালিয়ানা, ঠিক ততটাই মুড়ি-চানাচুর আর চায়ের কাপেও।
চানাচুর বেঁচে থাক বৈঠকখানার আড্ডায়, বেঁচে থাক চানাচুরপ্রেমীদের হৃদয়ে।