দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা তহবিল বন্ধ করবে যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্প প্রশাসন গ্যাভির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গ্যাভি একটি বৈশ্বিক সংস্থা, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিকা ক্রয়ে সহায়তা করে এসেছে এবং গত ২৫ বছরে কয়েক লাখ প্রাণ বাঁচিয়েছে।
এছাড়াও, প্রশাসন বিশ্বব্যাপী অন্যতম বড় প্রাণঘাতী রোগ ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর পরিকল্পনা করছে। এই সহায়তা কমানো বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে প্রশাসন এইচআইভি ও যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুদান এবং গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য খাদ্য সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এ সিদ্ধান্তগুলো একটি ২৮১ পৃষ্ঠার নথিতে করে গত সোমবার কংগ্রেসে পাঠিয়েছে। নথিটিতে যেসব বিদেশি সহায়তা প্রকল্প চালু থাকবে এবং যেগুলো বন্ধ করা হবে তার তালিকা রয়েছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এই নথির একটি কপি ও অন্যান্য সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করেছে।
নথিগুলো থেকে জানা যায়, গত এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে যেভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে সহানুভূতিশীল মিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছে, তারা সে পথ থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছে। প্রশাসন গত ৫০ বছরে অনেক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে।
নথির কভার লেটার বা সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে বলা হয়েছে, এ বাজেটে কাটছাঁটের ফলে ইউএসএআইডি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়বে। সংস্থার অধিকাংশ তহবিল বাতিল করা হবে এবং ছয় হাজারের বেশি কর্মীর মধ্যে মাত্র ৮৬৯ জন সক্রিয় দায়িত্বে থাকবেন। এটি ইউএসএআইডি-এর একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী মানবিক ও স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানের সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করতে পারে।
প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইউএসএআইডি -এর ৮৯৮টি প্রকল্প চালু থাকবে, কিন্তু বাকি পাঁচ হাজার ৩৪১টি প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাকি থাকা প্রকল্পগুলোর মোট মূল্য প্রায় ৭৮ বিলিয়ন ডলার, তবে এর মধ্যে মাত্র ৮.৩ বিলিয়ন ডলার এখনো ব্যয়যোগ্য অর্থ হিসেবে অবশিষ্ট রয়েছে।
ইউএসএআইডি-এর অবশিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন যে বন্ধ হওয়া প্রকল্পগুলোর তালিকা সঠিক। তিনি বলেন, প্রতিটি প্রকল্প আলাদাভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে যাতে এটি প্রশাসনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। যেসব প্রকল্পকে জাতীয় স্বার্থ বা সংস্থার নীতির পরিপন্থি বলে মনে করা হয়েছে, সেগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিওর অনুমোদনে বাতিল করা হয়েছে।
কংগ্রেসে পাঠানো স্মারকলিপিতে প্রশাসনের বিদেশি সহায়তা কমানোর পরিকল্পনাকে একতরফা সিদ্ধান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে, এইচআইভি চিকিৎসা ও টিকাদানের মতো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ অর্থ কংগ্রেস অনুমোদিত, তাই প্রশাসনের আইনি ক্ষমতা আছে কিনা সে প্রকল্পগুলো বন্ধ করার, তা স্পষ্ট নয়। এই বিষয়টি বর্তমানে বিভিন্ন আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বন্ধ হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হল জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) জন্য বরাদ্দ অর্থ, যা ৪৯টি দেশে পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত রোগ, যেমন বার্ড ফ্লু পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়া, বিশ্বের শিশুদের অন্যতম প্রধান প্রাণঘাতী রোগ ম্যালেরিয়ার শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধমূলক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিও বাতিল করা হয়েছে।
সিয়েরা লিওনের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ড. অস্টিন ডেম্বি যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্তে হতবাক ও উদ্বিগ্ন। তিনি সতর্ক করেছেন যে এর প্রভাব শুধু সিয়েরা লিওনে নয়, বিশ্বব্যাপী পড়বে।
তিনি বলেন, "এটি শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এতে শিশুদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে।"
ড. ডেম্বি আরও বলেন, "সিয়েরা লিওনে গ্যাভিকে সহায়তা করা শুধু আমাদের দেশের বিষয় নয়, এটি পুরো অঞ্চল ও বিশ্ব উপকৃত হয় এমন একটি উদ্যোগ।"
সিয়েরা লিওনে সকল শিশুকে নিয়মিত টিকার আওতায় আনার চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি, দেশটি বর্তমানে এমপক্সের প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াছে। ড. ডেম্বি বলেন, গ্যাভি টিকা ও তা সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখবে, যেমনটি সবসময় করে এসেছে। গ্যাভিতে অর্থায়ন ব্যয় নয় বরং একটি বিনিয়োগ।"
গ্যাভি প্রতিষ্ঠার ২৫ বছরের মধ্যে প্রায় ১.৯ কোটি শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সংস্থাটির মোট বাজেটের ১৩ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
বাতিল করা অনুদানের পরিমাণ ছিল ২.৬ বিলিয়ন ডলার। এটি ২০৩০ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকার কথা ছিল। গ্যাভি গত বছর প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর. বাইডেন জুনিয়রের প্রতিশ্রুত অর্থায়নের ওপর নির্ভর করছিল তার পরবর্তী তহবিল চক্রের জন্য।
সম্প্রতি নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর জন্য কিছু নতুন জীবনরক্ষাকারী টিকা বাজারে এসেছে। এর মধ্যে শিশুদের ম্যালেরিয়া থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি টিকা এবং কিশোরী মেয়েদের জরায়ু ক্যানসারের কারণ হওয়া ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য আরেকটি টিকাও রয়েছে। গ্যাভি এইসব দেশকে সহায়তা দেওয়ার জন্য তার তহবিলের পরিধি বাড়াচ্ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্যাভির জন্য বড় ধাক্কা। এটি শুধু বসন্ত ও পোলিওর মতো সাধারণ টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকেও দুর্বল করবে। নতুন টিকা সংযোজনের পরিকল্পনাও আরও পিছিয়ে পড়বে।
গ্যাভির নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ৭.৫ কোটি শিশু নিয়মিত টিকা পাবে না, যার ফলে ১২ লাখের বেশি শিশুর মৃত্যু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র গ্যাভির প্রথম সারির দাতাদের মধ্যে ছিল। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় সংস্থাটির বৃহত্তম দাতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় দেশগুলোও ঐতিহাসিকভাবে গ্যাভিকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থায়ন করেছে। তবে এখন অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন নীতির পরিবর্তন ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির চাপ সামলাতে গিয়ে বিদেশি সাহায্য কমাচ্ছে। গ্যাভির আরেক প্রধান দাতা জাপানও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে।
গ্যাভির প্রধান নির্বাহী ড. সানিয়া নিশতার আশা প্রকাশ করেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। তিনি বলেন, গ্যাভির কাজ শুধু দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বকে সুরক্ষিত রাখে। শিশুদের টিকা কেবল তাদের ব্যক্তিগতভাবে রক্ষা করে না। এটি বড় ধরনের সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিও কমায়। সংস্থাটি ইবোলা ও কলেরার মতো রোগের টিকাও সংরক্ষণ করে। প্রয়োজনে তারাই মহামারির সময় দ্রুত এসব সরবরাহ করে।
গ্যাভির কাঠামো অনুসারে, টিকা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কিছু টাকা পরিশোধ করতে হয়। দেশগুলোর আয় বাড়তে থাকলে এ পরিমাণও বাড়তে থাকে। যার কারণে মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে সহায়তা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে হয়।
যদিও প্রশাসন বারবার বলছে, তাদের বিদেশি সাহায্য পর্যালোচনা প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। তবে নথিগুলো থেকে বোঝা যায়, এখনও কিছু প্রকল্প পর্যালোচনা করা হচ্ছে।তাই কোন প্রকল্পগুলো টিকে যাবে, তা এখনো কিছুটা অনিশ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, ম্যালেরিয়া বিষয়ক একটি বড় প্রোগ্রাম কয়েক সপ্তাহ আগে বাতিল করা হয়েছিল এবং যা কংগ্রেসে পাঠানো বাতিল প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে, এর কর্মীরা সোমবার জানিয়েছেন যে এটি পুনরায় চালু করা হচ্ছে।
তবে, ম্যালেরিয়ার জন্য বরাদ্দ অর্থে বড় কাটছাঁট করা হয়েছে। যদিও বেডনেট এবং ম্যালেরিয়া চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের প্রকল্পগুলোর অর্থ সংরক্ষিত আছে। তারপরও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত দেশগুলো যেমন ক্যামেরুন এবং তাঞ্জানিয়ার মতো দেশের এসব এবং অন্যান্য ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অনেক প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছে। তাছাড়া কিছু সংস্থা প্রকল্প বাতিল করা না হলেও তারা দুই মাসের বেশি সময় ধরে কোনো তহবিল পায়নি এবং বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে, চিকিৎসাগুলো স্থানীয় ক্লিনিকে পৌঁছানোর জন্য কেউ থাকবে না।
এছাড়া মেমোতে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার পর্যন্ত ইউএসএআইডি-তে ৮৬৯ জন কর্মী কাজ করছিলেন। বাকি তিনি হাজার ৮৪৮ জন প্রশাসনিক ছুটিতে এবং এক হাজার ৬০২ জন ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়ায় আছেন। তবে প্রথমে ছাঁটাই করা ৩০০ জন প্রবেশনারি কর্মীর মধ্যে ২৭০ জন আদালতের আদেশের পর কাজে ফিরেছেন।