ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, শর্ত পূরণে ব্যর্থ ১৬ ব্যাংক

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (এআরএআর) বা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কমপক্ষে ১৬টি ব্যাংক।
এতে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে এআরএআর ৭ শতাংশের নিচে নেমে গেছে—যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্যের প্রকৃত তথ্য বিবেচনায় নেওয়া পর এ তথ্য বেরিয়ে এলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে অন্তত ১০ শতাংশ এআরএআর রাখতে হয়।
এআরএআর একটি ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা পরিমাপ করে, যেখানে মূলধনকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এটি নিশ্চিত করে যে, ব্যাংক সম্ভাব্য ক্ষতি সামাল দিতে এবং আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক এআরএআর ৬.৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে—যা জুন ২০২৪ শেষে ছিল ১০.৬৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ এআরএআর রাখতে হলেও গেল বছর সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ১৬টি ব্যাংক এই শর্ত পূরণ করতে পারেনি। যদিও জুন প্রান্তিক শেষে এমন ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ১১টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের ক্লাসিফায়েড লোন (সিএল) বা শ্রেণিকৃত ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর বিপরীতে প্রভিশন বেশি রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যাংক খাতের রিস্ক ওয়েইটেড অ্যাসেটের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, এসব অ্যাসেট ব্যাংক খাতের পুঞ্জিভূত ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, যেটি আদতে মূলধনকে কমিয়ে দিচ্ছে।"
"২০১০ সাল থেকে আমরা এআরএআর-এর এত বাজে পরিস্থিতি দেখিনি," যোগ করেন তিনি।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকখাতের সিএল ছিল মোট ঋণের ১৭ শতাংশের কাছাকাছি বা ২.৮৫ লাখ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে সেটি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের মোট সিএল'র প্রায় ৮২ শতাংশই সবচেয়ে খারাপ মান বা 'ব্যাড অ্যান্ড লস' ক্যাটাগরিতে চলে গেছে। এই মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের টিয়ার-১ মূলধন অনুপাত ৪.১৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় কম এবং নিয়মিত ন্যূনতম ৬ শতাংশ চাহিদার নিচে।
ওই প্রান্তিকে, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এআরএআর ছিল সর্বোচ্চ (৪৩.৬৭ শতাংশ), অন্যদিকে বিশেষায়িত উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর এআরএআর ছিল সর্বনিম্ন (–৪২.২০ শতাংশ)।
এছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এআরএআর সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নেগেটিভ (–২.৪৮%) হয়, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৫.৪৪ শতাংশ।
ডিসেম্বরের হিসাবে এআরএআর আরও নিচে নামতে পারে মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলেন, "ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সেইসঙ্গে প্রভিশন রিকোয়ারমেন্টও বেড়েছে। সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল বা প্রফিটেবিলিটি বাড়েনি। যদিও আমরা ডিসেম্বরের তথ্য নিয়ে কাজ এখনো শেষ করিনি, তবে ধারণা করছি এআরএআর আরও নিচে নামতে পারে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট রেগুলেটরি ক্যাপিটল ছিল ১.০৭ লাখ কোটি টাকা, যা ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ১.৬১ লাখ কোটি টাকার তুলনায় ৫৩,২৫৫ কোটি টাকা কম।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বাড়ার কারণে সামগ্রিক গড় অনুপাত কমে গেছে। এছাড়া, কিছু সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক তাদের লোকসান স্বীকার করা শুরু করেছে, যা মূলধন ঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।"
ব্যাংকিং খাতের এআরএআর কমে যাওয়ার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, "একটি প্রান্তিকের মধ্যে এআরএআর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে, এটি বিদেশি পক্ষগুলোর সঙ্গে আস্থার সংকট তৈরি করে। এর ওপর, সম্প্রতি মুডি'স আমাদের ক্রেডিট রেটিং কমিয়েছে; এতে বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ব্যয় বাড়াবে এবং আমাদের লোন লিমিটও (ঋণের সীমা) কমতে পারে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বল অবস্থা নতুন বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের প্রবাহেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।"
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "এআরএআর কমে গেলে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা হ্রাস পায়।"
মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর সুশাসন উন্নয়নের জন্য পুনঃমূলধনীকরণ (রিক্যাপিটালাইজেশন), শ্রেণিকৃত ঋণ পুনরুদ্ধারে জোর দেওয়া এবং মুনাফা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার।