পিজ্জা ডে ওয়ালি: ‘ফ্রম ইতালি, উইথ লাভ…’

পড়ন্ত শীতের তপ্ত দুপুর। গুলশানের ঝা চকচকে রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছি এক অজনপ্রিয় তথা আন্ডাররেটেড পিজ্জার রেস্তরাঁ, পিজ্জা ডে ওয়ালি। গুগল ম্যাপ দেখেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না এ জায়গা। পরে এক বাড়ির দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে পাওয়া গেল।
একটি ভবনের নিচ তলায়, গ্যারেজের পাশে ছোট কয়েকটি কামরা নিয়ে রেস্তরাঁটি। বাইরে নাম-ঠিকানা লেখা কোনো সাইনবোর্ডও নেই।
ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল ছিমছাম এক ফ্ল্যাট বাসা। বাসার ড্রয়িংরুমেই ছোট এই রেস্তরাঁ, পিজ্জা ডে ওয়ালি। মাঝের রুমে ক্যাশ কাউন্টার, পাশের দুই রুমে কিচেন আর স্টোর। রেস্তরাঁর মালিক ওয়াললি সাহেব এক গাল হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
খাঁটি ইতালীয় খাবারের খোঁজে ঢাকা শহরের অনেকেরই প্রথম পছন্দ এই পিজ্জা ডে ওয়ালি। রেস্তরাঁর মালিক ওয়ালি উল্লাহ নিজেই এখানকার প্রধান রাঁধুনি। প্রায় ১৫ বছর ইতালিতে থেকে সেখানকার খাবার তৈরি করা শিখেছেন তিনি।
২০১৯ সালে দেশে এসে এই রেস্তরাঁ খোলেন ওয়ালি। এর বিশেষত্ব হলো, এখানে খাঁটি ইতালীয় খাবার পাওয়া যায়। আর কাঁচামাল হিসেবে যা ব্যবহার করা হয়, তা সবই ইতালীয় পণ্য।
রেস্তরাঁটির আশেপাশে সব বিদেশি দূতাবাস। যার ফলে এর বেশিরভাগ ক্রেতাই বিদেশি। প্রায় ২৫০ জনের বেশি ইতালীয় নিয়মিত এখানে আসেন নিজ দেশের খাবারের স্বাদ নিতে।
রেস্টুরেন্টের অন্দরমহল পুরোটা সাজানো হয়েছে বিভিন্ন সময়ে খেতে আসা অতিথিদের ছবি দিয়ে। নানান দেশের বিখ্যাত রাঁধুনি, রাষ্ট্রদূত, রাজনীতিবিদ, কবি, পর্দার তারকা থেকে শুরু করে হালের সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার—সবার ছবিই সাজানো আছে পিজ্জা ডে ওয়ালির দেওয়ালে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবিও দেখা গেল অনেক ছবির মাঝে। পরিবার নিয়ে এসেছিলেন তিনি পিজ্জা ডে ওয়ালিতে।
আরানচিনি, তিরামিসু, ফেট্টুচিনি কিংবা পিজ্জা নাপোলিতানা—অথেনটিক ইতালীয় কুইজিনের খোঁজে আমরা আজ পৌঁছে গিয়েছি পিজ্জা ডে ওয়ালিতে। ঢাকার বুকে একখণ্ড ইতালি; পিজ্জা ডে ওয়ালির গল্প নিয়েই আজকের আয়োজন।

যেভাবে শুরু
ইতালি থেকে ২০১৯ এ দেশে ফিরে এসে বারিধারা ডিওএইচএসে প্রথম পিজ্জার রেস্তরাঁ খুলে বসেন ওয়ালি উল্লাহ। পরের বছর স্থান পরিবর্তন করে গুলশানে চলে আসেন। কিন্তু সে বছরই শুরু হয় করোনা। দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে নিজের শখের ব্যবসা শুরু করে প্রথমেই বাধার মুখে পড়েন ওয়ালি। তবে একটি অভিনব উপায়ে নিজের রেস্তরাঁর প্রচার ও প্রসার করেছিলেন তিনি সে সময়ে।
পিজ্জা ডে ওয়ালির ক্রেতাদের বড় অংশজুড়ে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের কর্মচারীরা। করোনার সময় তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারতেন না। দূতাবাসের ভেতরে একঘেঁয়ে খাবার খেয়ে দিন কাটাতে হতো তাদের। মূলত তাদের কথা ভেবেই ওয়ালি উল্লাহ ইউরোপীয় সব দূতাবাসের গেটের বাইরে খাঁটি ইতালীয় খাবার রেখে আসতেন। আর একটি চিরকুটে লিখে দিতেন, 'খেয়ে ভালো লাগলে, পরে টাকা দিয়ো!'
ওয়ালি উল্লাহর হাতে তৈরি ইতালীয় খাবার দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে কূটনৈতিক পাড়ায়। দূতাবাসের বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে পিজ্জা ডে ওয়ালি থেকে খাবার পাঠানো শুরু করেন ওয়ালি উল্লাহ। করোনার প্রকোপ কমে আসলে ধীরে ধীরে বাঙালিদের মাঝেও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে পিজ্জা ডে ওয়ালি। জন্মদিন বা বিয়ের আয়োজনে ক্যাটারিং সেবা দিয়ে থাকেন তারা।
পিজ্জা বা পাস্তার মতো ইতালীয় খাবার দেশের প্রায় সব ফাস্ট ফুড দোকানে পাওয়া যায়। কিন্তু পিজ্জা ডে ওয়ালির খাবার খেলে বোঝা যায়, আমাদের দেশের পিজ্জা বা পাস্তার স্বাদ পুরোটাই বাঙালিয়ানায় ভরপুর। তাতে অবশ্যই কোনো দোষ নেই। তবুও ভোজনরসিকরা খাঁটি ইতালীয় খাবারের খোঁজ করে চলে আসেন এই পিজ্জা ডে ওয়ালিতে।

মতিঝিল থেকে সিসিলি—ওয়ালি উল্লাহর বিচিত্র যাত্রা
২০০০ সাল থেকেই রান্নাবান্নার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ওয়ালি উল্লাহ। মতিঝিলের এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চার মাস কাজও করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে টঙ্গী কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান ইতালিতে।
কৈশোরের সেই রান্নার শখ থেকেই ইতালির সিসিলি প্রদেশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কাজ করা শুরু করেন ওয়ালি উল্লাহ। রান্না করা, সাহায্য করা, থালাবাসন ধোঁয়া, ঝাড়ামোছা—সবই করেছেন তিনি।
"২০০৮ সাল থেকে আমি একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করা শুরু করি। সেখানে প্রতিদিন কাঠের ওভেনে ১,২০০ কেজি ব্রেড (রুটি) তৈরি করতে হতো। এছাড়াও, ২৫০ ক্রোস্যান্ট (এক ধরনের বিশেষ ফরাসি রুটি) বানাতাম প্রতিদিন। পিজ্জা বানাতে হতো, একেকটি ৩০ ইঞ্চি সাইজের। তখনই আমি হাতে পাস্তা বানানো শিখি। আমাকে পাস্তা বানানো শিখিয়েছেন ১০৩ বছর বয়সী এক ইতালিয়ান ব্যাক্তি। এই পাস্তা বানানো শিখতে গিয়ে আমি যে মার খেয়েছি উনার হাতে!," বলছিলেন ওয়ালি উল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, "এই রেস্টুরেন্টে ভোর ৪টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত টানা কাজ করতাম। ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিরতি থাকতো। এই তিন ঘণ্টার বিরতিতে আমি আরেক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিনামূল্যে কাজ করতাম। শুধু নতুন কয়েকটা ইতালীয় রেসিপি শেখার জন্য।"
"আবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় আমি সিসিলি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের এক জায়গায় যেতাম ইতালীয় মাছের ডিশ কীভাবে বানানো হয়, সেটা শিখতে," যোগ করেন তিনি।

২০১৪ সালে ছুটি কাটাতে দেশে আসেন ওয়ালি উল্লাহ। তখন দেশে বিদেশি খাবার জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ঢাকার মোড়ে মোড়ে ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট গজিয়ে উঠছিল দ্রুতই। এ দেখে ওয়ালি উল্লাহ ভাবলেন, ইতালীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট খুললে কেমন হয়? ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তর করার চিন্তা থেকেই আবার ফিরে যান ইতালিতে।
দীর্ঘদিন ইতালিতে রেস্টুরেন্ট লাইনে কাজ করার কারণে অনেক জায়গায়ই পরিচিতি পান ওয়ালি উল্লাহ। ইতালীয় রান্নায় হাত পাকানোর জন্য বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। যার ফলে ইতালির অনেক রেস্টুরেন্টে বড় বড় রাঁধুনির সাথে তার ভালো সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাদের সাথে নিজের দেশে ইতালীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট কীভাবে খোলা যায়, কী ধরনের মেন্যু থাকবে, কীভাবে ইতালি থেকে কাঁচামাল দেশে নিয়ে যাবেন—এসব বিষয়ে নিয়মিত আলাপ করতেন ওয়ালি উল্লাহ।
এসব বিষয়ে ধারণা নিয়ে ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু সে বছরই গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলা হয়। এ হামলার সময় হলি আর্টিসানের পাশেই ছিলেন ওয়ালি উল্লাহ। হামলার ভয়াবহতা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। ৯ জন ইতালীয়সহ মোট ২৪ জন মারা যান ওই হামলায়। রেস্টুরেন্ট খোলার চিন্তা তখন আপাতত বাদ দিয়ে ফের ইতালি চলে যান তিনি। পরে ২০১৯ এ আবার দেশে ফিরে আসেন। এসে চালু করেন তার স্বপ্নের রেস্তোরা, পিজ্জা ডে ওয়ালি।

খাঁটি স্বাদের জন্য খাঁটি কাঁচামাল
পিজ্জা ডে ওয়ালির অন্যতম বিশেষত্ব হলো তাদের রান্নার উপকরণের ৯৫ ভাগই ইতালি থেকে আমদানি করে আনা হয়। ওয়ালি উল্লাহ নিজেই দুই মাস পর পর ইতালিতে যান বিভিন্ন ইতালীয় পণ্য কিনে আনতে। আর দেশ থেকে যেসব পণ্য কেন হয়, তাও উৎপাদিত হয় তার নজরদারিতে।
ইতালীয় খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো বেসিল বা এক ধরনের তুলসী পাতা। ওয়ালি উল্লাহ ময়মনসিংহের একজন চাষী থেকে বেসিল পাতা সংগ্রহ করেন। সেখানে অর্গানিক উপায়ে বেসিল উৎপাদন করা হয়।
ইতালি থেকে প্রায় ১০ ধরনের পনির বা চিজ নিয়মিত আমদানি করেন ওয়ালি। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় মহিষের দুধ দিয়ে বানানো মোজারেলা চিজ বা বাফালো চিজ। এই চিজ দেশে উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছেন ওয়ালি উল্লাহ। বরিশাল, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ আরও কয়েক জায়গা ঘুরে, শেষ পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও এর এক ফার্মে পেয়েছেন খাঁটি বাফালো চিজের সন্ধান।
"২০ বছর আগেও দেখতাম, আমাদের দেশে দুধ জ্বাল দিলে উপরে ঘন হলুদ একটা সর বসে। এখন আর সেই জিনিস দেখা যায় না। এখন ক্যাটেলকে (গরু, মহিষ) খড় বা বিভিন্ন ফিডের ক্যামিকেল খাবার দেওয়া হয়। এজন্য খাঁটি দুধ আর পাওয়া যায় না। চিজও ভালো হয় না এ কারণে। কিন্তু আমি ঠাকুরগাঁয়ে এক ফার্মের সন্ধান পেয়েছি যেখানে শুধু ঘাস খাওয়ানো হয় ক্যাটেলকে। আমি সেই দুধ দিয়ে বাফালো চিজের সোর্স করি," বলছিলেন ওয়ালি উল্লাহ।

ইতালি থেকে নিয়মিত বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে আসেন তিনি। চিজ, টমেটো, মশলা, মাশরুম, পাস্তা, দুধ, অলিভ—এমনকি লবণ পর্যন্ত ইতালি থেকে নিয়ে আসা হয়। অতিথিদের যেন খাঁটি ইতালীয় স্বাদ দিতে পারেন, সেজন্য কোনো কার্পণ্য করেন না ওয়ালি। পাঁচ থেকে ছয়জন লোক ইতালি থেকেই বিভিন্ন উপকরণ পাঠান বাংলাদেশে।
ইতালির সিসিলিতে একটি আগ্নেয়গিরির নিচে কিছু বিশেষ মশলা হয়, যা ইতালীয় খাবারের জন্য অপরিহার্য। ওয়ালি উল্লাহ নিয়মিত সেসব মশলা আনান ৭৫ বছর বয়সী এক ইতালীয় ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে, যিনি সেই আগ্নেয়গিরির পাশেই থাকেন।
ইতালির আরেকটি প্রদেশ লাম্বোর্দি থেকে ভেড়ার দুধের চিজ আমদানি করেন তিনি। এই ভেড়ার দুধের চিজ দিয়ে বানানো পাস্তা ইতালির ক্রেতাদের কাছে অনেক জনপ্রিয় বলে জানালেন ওয়ালি উল্লাহ।
পিজ্জা ডে ওয়ালির স্টোর রুমে দেখা গেল তাকে তাকে সাজানো বিভিন্ন ইতালীয় পণ্য। এগুলো বাইরেই রাখা। যেন অতিথিরা নিজেরাই দেখতে পান তাদেরকে কী খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। ফ্রিজও রাখা মাঝখানের রুমেই। ফ্রিজে সাজানো নানা রকমের বাহারি চিজ আর পাস্তা। এখান থেকে নিয়েই তৈরি করে দেওয়া হয় খাবার।

ওয়ালি উল্লাহ জানান তাদের রেস্তরাঁয় প্রায় ৪০ লাখ টাকার টমেটো আর ১০ লাখ টাকার অলিভ অয়েল মজুত করে রাখা আছে। এর সবই ইতালি থেকে আনা। প্রায় সকল ইতালীয় খাবারেই অলিভ অয়েল আর টমেটো ব্যবহার করা হয়। তাই এগুলো বেশি করে এনে রাখা হয়েছে বলে জানান ওয়ালি উল্লাহ।
কিছুদিন আগেও ১২০ কেজি ওজনের সোর্ড মাছ আনিয়েছেন তিনি ইতালি থেকে। এখন তা পরিবেশন করা হচ্ছে অতিথিদের জন্য। আর দেশ থেকে যা মাছ ব্যবহার করা হয়, তা কিনে আনা হয় কক্সবাজার থেকে। সামুদ্রিক মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ ব্যবহার করা হয় না এ রেস্তরাঁয়। মুরগি বা গরুর মাংসও কেনা হয় বেঙ্গল মিটের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে—যারা নির্দিষ্ট মান বজায় রাখে।
রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখা গেল পিজ্জা তৈরি করার জন্য ময়দার ডো বানিয়ে রাখা হয়েছে ট্রে তে। ওয়ালি উল্লাহ ডো দেখিয়ে বললেন, "রেস্তরাঁর সব পাস্তা আর ব্রেড আমি নিজেই বানাই। আপনি আমার এখানে দশটা পিজ্জা খেলেও পেটে ফাঁপ ধরা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হবে না। কিন্তু বাইরে তিন স্লাইস পিজ্জা খেয়ে দেখেন—পেটে ফাঁপ ধরবে। কারণ অন্যান্য জায়গায় ডো তে ইস্ট ব্যবহার করা হয় ফোলানোর জন্য। কিন্তু ইতালীয়রা কখনোই ইস্ট ব্যবহার করে না। আমিও করি না। ডো দিয়েই আবার ডো বানানো হয়। যাকে বলে মাদার-ডো ব্যবহার করা। পাস্তাও একইভাবে বানানো হয়।"

যা পাওয়া যায়
ইতালীয় কুইজিনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো অ্যালকোহল। ভালো ভালো অনেক খাবারেই ওয়াইন ব্যবহার করেন ইতালীয়রা। সে খাবারগুলো কীভাবে অ্যালকোহল ব্যবহার না করে প্রস্তুত করা যায়, সে বিষয়ে দেড় বছর গবেষণা করেছেন ওয়ালি উল্লাহ।
পিজ্জা ডে ওয়ালিতে কোনো ধরনের অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয় না। এখানকার খাবারে পাঁচ ধরনের চিজ বেশি ব্যবহার করা হয়—মোজ্জারেলা, পারমেজান, গ্রানাপাদানো, গরগোনজোলা এবং প্রোভোলন।
আরানচিনি, রিসোত্তো, ক্রকেট, ব্রুশকেত্তা, লাসানিয়া, কাপরিসি সালাদ, গ্রিক সালাদ, রাভিওলি, পানিনি, কালোনে ইত্যাদি নানা ধরনের বাহারি ইতালীয় খাবার পাওয়া যায় এখানে। এছাড়াও পাওয়া যায় অনেক ধরনের পিজ্জা আর পাস্তা।
স্প্যাঘেতি, ন্যোকি, কাভাতেলি, ফেত্তুচিনি, রিগাতোনি বা পেন্নে—যেকোনো পাস্তা চাইলেই বানিয়ে দেওয়া হয় পছন্দ অনুযায়ী সস দিয়ে। আর পিজ্জা খেতে চাইলে আছে মার্গারিতা, পেপেরোনি, ফোর চিজ, ফাংগি, নাপোলিতানা, মারিনারা, কাপ্রিশিওসা, নোরমা, বিয়াংকা, আমাট্রিশিয়ানাসহ আরও নানান ধরনের পিজ্জা। ডেজার্ট খেতে চাইলে আছে ক্লাসিক তিরামিসু। মালয়েশিয়া থেকে কফি বিন নিয়ে এসে নিজেই তিরামিসু বানান ওয়ালি উল্লাহ।

"আমাদের মা-বোনেরা যেভাবে চালের গুড়া দিয়ে চিতই পিঠা তৈরি করেন, ইতালিতেও একইভাবে মা-বোনেরা পাস্তা তৈরি করে থাকেন। আমি ঠিক সেই পদ্ধতিটাই অনুসরণ করার চেষ্টা করি। হাতে বানানো পাস্তা আর বাজারে কেনা পাস্তার মধ্যে পার্থক্য খেলেই বোঝা যায়," বললেন ওয়ালি উল্লাহ।
আরও জানালেন, "ইতালির ২১টা প্রদেশে একটা আইটেম ২১ ভাবে বানানো হয়। ওদের রান্নার বৈচিত্র্য অনেক। আমার রেস্তরাঁর মেন্যুতে কোনো নির্দিষ্ট আইটেম নেই। প্রায় ২০০০ এর বেশি ইতালীয় আইটেম তৈরি করতে পারি আমি। উপকরণের প্রাপ্যতা অনুযায়ী মেন্যুতে পরিবর্তন আনি।"
খাবারের দামও মোটামোটি হাতের নাগালেই। ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ১,২০০ টাকার মধ্যেই বেশিরভাগ খাবারের দাম। বিশেষ আইটেমগুলোর দাম ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকার মধ্যে। পিজ্জা ডে ওয়ালিতে একবারে মাত্র ২২ জন বসে খেতে পারেন। প্রতিদিন দুপুরে আর রাতে– দুইবেলায় মোট ৪৪ জনের জন্য খাবার তৈরি করা হয় এখানে। এর বেশিও না, কমও না।
এর কারণ জিজ্ঞেস করলে ওয়ালি উল্লাহ বলেন, "খাবারের মান বজায় রাখা আমার প্রধান লক্ষ্য। এখানে যারা খেতে আসেন, তাদের অধিকাংশই নিয়মিত আসেন। তারা আসার আগে ফোন করে বুকিং দিয়ে আসেন। ২২ জনের বেশি যদি হয়ে যায়, আমরা আসতে না করি।"

পিজ্জা ডে ওয়ালি থেকে বানানো পাস্তা আবার বক্স আকারে বিক্রিও করা হয়। র্যাভিওলি, ন্যোকি, ক্যাভাতেলি—এসব পাস্তা ফ্রোজেন অবস্থায় বিক্রি করা হয়। অনেক ক্রেতা এসে বসার জায়গা না পেলে কিনে নিয়ে যান এসব ফ্রোজেন পাস্তা। বাড়িতে নিয়ে কীভাবে বানিয়ে খেতে হবে, সে নির্দেশনাও তাদেরকে দিয়ে দেন ওয়ালি উল্লাহ।
ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনা
"এই রেস্তরাঁ আমার শখ। মানুষকে খাওয়াতে আমার ভালো লাগে। ব্যবসা হিসেবে আমি কখনোই দেখিনি এই কাজকে। ইতালিতে আমার জন্য মাসিক ১০ লাখ টাকা বেতনের চাকরির অফার আছে। দেশেও চাইলে আমি যেকোনো পাঁচ তারকা হোটেলে চাকরি নিতে পারি। কিন্তু হোমমেড ইতালীয় খাবার খাওয়াতে চাই আমি দেশের মানুষকে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। তাই এই রেস্তরাঁ আমার শখের জায়গা," স্মিত হেসে বলছিলেন ওয়ালি উল্লাহ।
কখনোই বাণিজ্যিক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন না তিনি। এজন্যই রেস্তরাঁর বাইরে কোনো সাইন বোর্ডও দেওয়া নেই। খুব বেশি প্রচারণাও চালান না কোথাও। ক্যাটারিং বা লাইভ পিজ্জা ইভেন্টের মাধ্যমে মানুষের মাঝে নিজের পরিচিতি বাড়ান তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন মেলায় খাবারের স্টল দেন ওয়ালি উল্লাহ।
কিছুদিন আগে আলোকিতে হয়ে যাওয়া ঢাকা মেকার্স-৩ এ স্টল দিয়েছিল পিজ্জা ডে ওয়ালি। সেখানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চিজ হুইলের ওপর পাস্তা বানিয়ে পরিবেশন করা হয়।
পিজ্জা ডে ওয়ালি থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে গাজীপুরে নিজ এলাকায় নিজের মায়ের নামে একটি এতিমখানা চালু করেছেন ওয়ালি উল্লাহ। সেখানে প্লে গ্রুপ থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে ৭৭ জন এতিম শিশুকে। তাদের থাকা-খাওয়া, শিক্ষকদের খরচ- সবই বহন করা হয় পিজ্জা ডে ওয়ালি থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে। এমনকি, ওয়ালি উল্লাহ নিজের দুই সন্তানকেও পড়ান এখানে। ইতালির অ্যাম্বাসেডর অ্যান্তনিও আলেহান্দ্রো গিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন করে এসেছিলেন।

ইতালি থেকে কাঁচামাল আমদানি করা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে ওয়ালির জন্য। আগে গ্রানাপাদানো চিজ কেনা যেত ১,২০০ টাকা কেজি। এখন তার দাম বেড়ে হয়েছে ৩,০০০ টাকার ওপরে। বাকি সব পণ্যের দামও উর্ধ্বমুখী। সে তুলনায় খাবারের দাম বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানালেন ওয়ালি উল্লাহ। আর এখানে খাবারের উপকরণের কোনো বিকল্পও ব্যবহার করা হয় না। তাই, কোনো পণ্য না পাওয়া গেলে মেন্যু থেকে সেই আইটেম বাদ দিয়ে দিতে হয় তাকে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন না ওয়ালি উল্লাহ। দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কায় আছেন তিনি। যতদিন বাবা-মা বেঁচে আছেন, ততদিন দেশে থাকবেন বলে জানালেন।
এর মধ্যেই বনানী, উত্তরা ও ধানমন্ডিতে আরও তিনটি শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে তার। অতিথিদের দূরদূরান্ত থেকে তার খাবার খেতে এসে ফিরে যেতে হয়, জায়গা পান না বসার—এমনটি যেন আর না হয়, সেজন্যই এ উদ্যোগ।
ওয়ালি উল্লাহর সাথে আড্ডার শেষ মুহূর্তে রেস্তরাঁয় ঢুকলেন দুই ইতালীয় ব্যক্তি। ইতালিয়ান ভাষায় তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসালেন ওয়ালি উল্লাহ। জানা গেল, তারা প্রায় প্রতিদিনই খেতে আসেন পিজ্জা ডে ওয়ালিতে। কেমন লাগে এখানকার খাবা?—জানতে চাইলাম দু'জনের কাছেই। তারা বললেন, "ওয়ালির হাতের রান্না খেয়ে মনে হয় ইতালিতেই আছি, আর মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি। স্বাদে একদম ফ্রম ইতালি–উইথ লাভ!"
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন/টিবিএস