‘হয়তো সে অপরাধী ছিল, তা-ই বলে এত নির্মমভাবে মারতে হলো?’ প্রশ্ন জুম্মনের বোনের

বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৪টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের বাইরে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন ৩৫ বছর বয়সি আকলিমা বেগম।
ওই হাসপাতালেই কাজ করেন তিনি। অপেক্ষা করছিলেন কখন ডাক্তাররা তার ভাই মো. জুম্মনের ময়নাতদন্ত শেষ করবেন। আগেরদিন ভোরে মোহাম্মদপুরে যৌথবাহিনীর অভিযানে নিহত দুজনের একজন জুম্মন। ময়নাতদন্ত শেষ হলেই আকলিমা ভাইয়ের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন।
'সমাজের চোখে হয়তো সে অপরাধী ছিল, কিন্তু সেজন্য তাকে এত নির্মমভাবে হত্যা করতে হলো?' মর্গের বাইরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রশ্ন করেন আকলিমা।
পুলিশ ও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) ভাষ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে 'গুলি বিনিময়ের' সময় জুম্মন ও তার কথিত সহযোগী মিরাজ হোসেন নিহত হন।
'আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কেউ বাঁচতে পারে না। তিনি [আল্লাহ] জুম্মনকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে গেছেন, এটাই তার ভাগ্য ছিল,' ময়নাতদন্ত শেষে আত্মীয়দের বলতে শোনা যায় আকলিমাকে।
ভাইয়ের মরদেহ দেখতে মর্গে গিয়ে আকলিমা বলেন, 'তার শরীরের এক পাশ থেকে আরেক পাশে গুলি লেগেছে। ডান পায়ের গোড়ালির ওপরে, কোমরের নিচে গুলি লেগেছে, আরেকটি গুলি তলপেট ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।'
'গুলিবিনিময়ের' পর জুম্মনের মরদেহ পাওয়া যায় তার বাড়ি থেকে মাত্র এক মিনিট দূরত্বে।
'আমরা শুনেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে, জুম্মন ও মিরাজই প্রথমে গুলি চালায় এবং পালানোর চেষ্টা করে। পরে জুম্মনের গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত মরদেহ পাওয়া যায়,' বলেন আকলিমা।
তবে যৌথবাহিনীর প্রকাশ করা নিহতদের ছবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
'একটা বিষয় অযৌক্তিক মনে হয়েছে। প্রথমে আমরা যে ছবিগুলো দেখেছিলাম, সেখানে জুম্মনের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। পরে প্রকাশ করা ভালো রেজল্যুশনের ছবিতে দেখা যায়, তার হাতে একটা রামদা ধরা। আমার বিশ্বাস, এগুলো সাজানো ছবি। একাধিকবার গুলি খাওয়ার পর কেউ ভারী অস্ত্র ধরে রাখতে পারে না,' বলেন আকলিমা।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কাছে তার ভাইয়ের মৃত্যুর আগের শেষ মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দেন।
'বুধবার রাত ৯টার দিকে জুম্মন চাঁদ উদ্যান হাউজিংয়ের ৫ নম্বর গলিতে তার বাড়িতে ছিল। মিরাজের ফোন পেয়ে বেরোতে চাইলে তার বউ বর্ষা বাধা দেয়। যৌথবাহিনীর অভিযানের গুঞ্জন শুনে সে [বর্ষা] দু'বার দরজা বন্ধ করেও তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করে,' বলেন আকলিমা।
'রাত ১১টার দিকে মিরাজ আবার ফোন করলে সাড়ে ১১টা নাগাদ বর্ষার নিষেধ না শুনে জুম্মন ঘরে স্ত্রী ও এক বছরের শিশুসন্তানকে রেখে বেরিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১২টার পর শুনি, যৌথবাহিনী মেগাফোনে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাচ্ছে। পাঁচজন আত্মসমর্পণ করলেও জুম্মন ও মিরাজ করেনি,' বলেন আকলিমা।
তিনি জানান, তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে 'ছোটখাটো মামলা' ছিল, যার জন্য সে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিত।
স্থানীয়দের কাছেও জুম্মন অপরাধী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
'"জুম্মন" নামটা যেন অপরাধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। যে কোনো অপরাধ হলেই, সে করুক বা না করুক, সবাই তার দিকেই আঙুল তুলত। তার নামটা অভিশাপে পরিণত হয়েছিল,' বলেন আকলিমা।
সাবেক টাইল-মিস্ত্রি জুম্মন গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চাকরি হারান। পরে মিরাজের সঙ্গে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ে যোগ দেন তিনি।
'সে আমার কথা শোনেনি, এখন সে আর নাই': মিরাজের বাবা
নিহত মিরাজ হোসেনের (২৫) বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান ছেলের মরদেহ নেওয়ার জন্য পুলিশের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করছিলেন।
চা দোকানের মালিক শাহজাহান জানান, তার ছেলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাত এবং মাঝে মাঝে তাকে দোকানে সাহায্য করত।
'রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওকে শেষবার দেখেছিলাম। বলেছিলাম, যৌথ অভিযান চলছে, বেরোস না। কিন্তু সে শোনেনি। এখন সে আর আমার কাছে নেই,' বলেন তিনি।
নিহত মিরাজের স্ত্রী ও তিন বছরের এক সন্তান রয়েছে।
'ওর বিরুদ্ধে হেরোইন সংক্রান্ত একটি মামলা ছিল। আমি মনে করি, ওকে ফাঁসানো হয়েছিল। পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল সে। কিন্তু ওকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা মেনে নিতে পারছি না,' বলেন শাহজাহান।