২০২৪ সালের ডিসি সম্মেলনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি

২০২৪ সালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্তের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের 'দর্শনগত পার্থক্য' থাকায় জেলা প্রশাসক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার নেমেছে সবচেয়ে কম পর্যায়ে।
গত বছরের ডিসি সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ এমন মন্তব্য করেছেন।
ওই প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পর আগের সরকারের দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে বিগত জেলা প্রশাসক সম্মেলনগুলোর তুলনায় এ বছর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হার কম হয়েছে।
আগামী ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে হবে চলতি বছরের ডিসি সম্মেলন। এবারের ডিসি সম্মেলন উপলক্ষে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের কাছ থেকে ১ হাজার ২৪৫টি প্রস্তাব পায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তার মধ্যে কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ৩৫৩টি প্রস্তাবের ওপর সম্মেলনে আলোচনা হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দ্বিমত করায় এবং আগের ডিসি সম্মেলনে উপস্থাপিত হওয়ায় অনেক প্রস্তাব কার্যপত্রে রাখা হয়নি। এবার ডিসি সম্মেলনে ৩৪টি কার্য-অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তার সঙ্গে ডিসিদের মুক্ত আলোচনা হবে। সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভা হবে। রাতে হবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নৈশভোজ।
দ্বিতীয় দিন কার্য-অধিবেশনের বাইরে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ডিসিরা। তবে এবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ডিসিদের সৌজন্য সাক্ষাৎ রাখা হয়নি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত বছরের ডিসি সম্মেলনে ১১৯টি স্বল্পমেয়াদি, ১৯২টি মধ্যমেয়াদি ও ৭০টি দীর্ঘমেয়াদিসহ মোট ৩৮১টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। স্বল্পমেয়াদি ৬৪ শতাংশ, মধ্যমেয়াদি ৪০ শতাংশ ও দীর্ঘমেয়াদি ৩৬ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসি সম্মেলনের ৪৬ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭৬ শতাংশ, ২০২২ সালের ৮৬ শতাংশ, ২০১৯ সালের ৮৮ শতাংশ এবং ২০১৮ সালের ৯৩ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ডিসি সম্মেলন হয়নি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিসি সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার সবসময় ৭৫ শতাংশের ওপরে থাকে। সরকার পরিবর্তনের কারণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কম হয়েছে।
কোন প্রস্তাবগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। তবে একলাফে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার জন্য সরকার পরিবর্তনের পর জনপ্রশাসনে চরম অস্থিরতাকে দায়ী করেন কর্মকর্তারা।
আগের সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এছাড়া আগের সরকারের জেলা প্রশাসকদের সরিয়ে নতুন করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। কয়েকটি জেলায় বেশ কিছুদিন জেলা প্রশাসক ছিলেন না। অনেক মন্ত্রণালয়ে সচিব ছিলেন না। আবার একজন উপদেষ্টা একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। অনেক জায়গায় ঠিকদাররা অনুপস্থিত থেকেছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না। সর্বোপরি স্থানীয় রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের প্রভাবও পড়েছে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ডিসি সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত জনসাধারণের সেবা উন্নত করা, স্থানীয় সম্ভাবনা কাজে লাগানো ও সমস্যা দূর করার জন্য নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলে জনসেবা বা সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, ডিসি সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ করতে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে অগ্রগতি প্রতিবেদন সংগ্রহ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এছাড়া গত বছর তিনটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এসব কর্মশালায় কিছু কিছু স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুবিধার্থে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি শ্রেণিতে স্থানান্তর করা হয়।
যেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি
সরকারি হাটবাজার ইজারা দিয়ে পাওয়া আয় বণ্টন সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করে ইজারালব্ধ আয় ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নের জন্য ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব গত বছরের ডিসি সম্মেলনে নেওয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে নয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
এরপর সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের সুবিধার জন্য প্রস্তাবটি মধ্য মেয়াদে স্থানান্তর করা হয়েছে। অনলাইনে হাটবাজার ইজারার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডগুলোর প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি বলে অগ্রগতি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ভাস্কর্যগুলো দ্রুততার সঙ্গে সংস্কারের সিদ্ধান্ত গত বছরের ডিসি সম্মেলনে হয়েছিল। অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ডিসির কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
কৃষিতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের হার অনুযায়ী মৎস্য খামার ও হ্যাচারির বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বজ্রপাত নিরোধক ছাউনি স্থাপনের জন্য কর্মসূচি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
টিআর-বিষয়ক নীতিমালায় নন-রেজিস্টার্ড সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও পাঠাগারকে অন্তর্ভুক্তের সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ইট পোড়ানোর লাইসেন্স ও নবায়ন ফি ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
পদ্মা সেতু ও শিমুলিয়া নদীবন্দর এলাকাকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে পর্যটন এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও এটি মধ্য মেয়াদ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থানান্তর করা হয়েছে।
প্রতিটি জেলায় কর্মজীবী মহিলাদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের সুবিধাসংবলিত একটি করে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাবও বাস্তবায়ন হয়নি। অতি প্রবীণদের জন্য অতি প্রবীণ বয়স্ক ভাতা চালুর উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও এ বিষয়ে কোনো কাজই করেনি সরকার।