সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫০ বছরের নিষ্ঠুরতার অবসান, প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা

সিরিয়ার দামেস্কের মুস্তাহিদ হাসপাতালের বাইরের একটি দেয়ালে মৃত পুরুষদের মুখাবয়বের ছবি রয়েছে। এসব পুরুষদের মুখাবয়ব দেখে মনে হয়, তারা অত্যন্ত যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেছেন।
দেয়ালে যাদের ছবি দেখা যাচ্ছিল, তাদের মৃতদেহ হাসপাতালের ভেতরে রাখা রয়েছে। মৃতদেহগুলো দামেস্ক শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে আরেকটি হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, নিহত সবাই কারাবন্দি ছিলেন।
নিহতদের স্ত্রী, ভাই, বোন এবং বাবা-মায়েরা হাসপাতালটিতে আসছেন তথ্যের খোঁজে। তারা আশায় আছেন, প্রিয়জনের মৃতদেহ খুঁজে পেইয়ে সেটির যাতে দাফন সম্পন্ন করতে পারেন।
তারা ছবিগুলোর কাছে যান, নিজেদের পরিচিত মুখ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ ছবিগুলোর ভিডিও করেন যাতে পরবর্তীতে বাসায় নিয়ে গিয়ে অন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে মতামত নিতে পারেন।
এটি এক ভয়াবহ কাজ। কয়েকজন পুরুষের মৃতদেহ কয়েক সপ্তাহ আগের মনে হচ্ছিল, তাদের মুখাবয়বে পচন ধরেছে।
ছবির দেয়াল থেকে পরবর্তীতে তারা মৃতদেহের সন্ধানে মর্গে প্রবেশ করেন।
মুস্তাহিদ হাসপাতাল ৩৫টি মৃতদেহ রাখা আছে। কিন্তু সেগুলো হাসপাতালের মর্গের ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত একটি রুমে বডিব্যাগে ভরে ট্রলিতে রাখা হয়েছে। বডিব্যাগ খুলে রাখা হয়েছে যাতে স্বজনরা মৃতদেহের চেহারা দেখে শনাক্ত করতে পারেন।
কিছু মৃতদেহ দ্রুত পচে যাওয়ায় সাদা কাপড়ে প্যাঁচানো ছিল। এর মধ্যে, পরিচিত মুখাবয়ব অথবা ট্যাটু কিংবা দাগ দেখে কারও কারও মৃতদেহ শনাক্ত করা যাচ্ছিল।
একটি মৃতদেহ পরনে ছিল ডায়াপার। অন্য একজনের বুকের ওপর স্টিকি টেপে একটি সংখ্যা লেখা ছিল। এমনকি তাকে হত্যা করার সময়ও কারারক্ষীরা তাকে কোনো মর্যাদা দেয়নি।
সব মৃতদেহ শীর্ণ ছিল। যে-সব ডাক্তাররা মৃতদেহগুলো পরীক্ষা করেছিলেন তারা বলেন, দেহগুলোর ওপর মারধরের চিহ্ন, তীব্র আঘাত এবং একাধিক হাড় ভাঙার চিহ্ন রয়েছে।
ফরেনসিক দন্তচিকিৎসক ডা. রাঘদ আত্তার বিভিন্ন পরিবারের দেওয়া দাঁতের রেকর্ড পরীক্ষা করে মৃতদেহ চিহ্নিত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি জানান, তিনি একটি রেকর্ড তৈরি করছেন যাতে সেটি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তারপর তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি অনেকটা ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, "আপনি সবসময় শুনতে পান, বন্দিরা দীর্ঘ সময়ের জন্য হারিয়ে যায়। কিন্তু এটা দেখা খুবই কষ্টকর। আমি গতকাল এখানে এসেছিলাম। এটি আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আমরা আশা করি, ভবিষ্যৎ ভালো হবে। কিন্তু এটি খুব কঠিন। আমি এই পরিবারগুলোর জন্য সত্যিই দুঃখিত। আমি তাদের জন্য খুব দুঃখিত।"
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সিরিয়া ৫০ বছরের আসাদ শাসন থেকে নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না?
ডা. রাঘদ বলেন, "আমি জানি না, আমি আশা করি। আমি অনুভব করি, ভালো দিন আসছে। কিন্তু আমি চাই সকল দেশ আমাদের সাহায্য করুক। যেকোনো কিছু আমাদের সাহায্য করতে পারে। যেকোনো কিছু …"
নূর নামে এক নারী জানান, তার ভাইকে ২০১২ সালে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তখন তার ৯ভাই) বয়স ছিল ২৮ বছর।
তারপর থেকে তারা কেবল একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পেরেছিলেন, তার ভাইকে সাইদনায়া কারাগারে রাখা হয়েছে এবং সেখানে বন্দিদের কয়েক দশক ধরে পচে মরার জন্য ছেড়ে দেওয়া হতো।
নূর বলেন, "এটা কষ্টদায়ক। একই সময়, আমাদের আশা রয়েছে; যতক্ষণ না তাকে মৃতদেহের মধ্যে খুঁজে পাই। কিছু হলেও, যেন সে নিখোঁজ না থাকে। আমরা তার কিছু খুঁজে পেতে চাই। আমরা জানতে চাই, তার সঙ্গে কী ঘটেছিল। আমরা এই যন্ত্রণার শেষ চাচ্ছি।"
এক দম্পতি চিকিৎসককে জানান, তাদের ছেলে তার ল্যাপটপ পরীক্ষা করার জন্য খুলতে অস্বীকার করায় তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
প্রাসাদ
৫০ বছরের আসাদ পরিবারের শাসন মানে ৫০ বছর ধরে গুম, বন্দিত্ব, হত্যাকাণ্ড। এটা বন্দিদের প্রতি নির্মম নিষ্ঠুরতা, তাদের পরিবারের প্রতি নির্দয় আচরণ এবং সেই সিরীয় জনগণের প্রতি অত্যাচার, যারা আসাদের আস্থার বলয়ে ছিলেন না।
মুস্তাহিদ হাসপাতালের ছবির দেয়াল এবং মর্গে তারা জানতে চাচ্ছিলেন, কী ঘটেছিল? তারা জানতে চান কিছু তথ্য এবং যদি তারা ভাগ্যবান হন, তাহলে একটি মৃতদেহ হয়ত পাবেন।
তারা একটি হিসাব চাচ্ছিলেন এবং অনেকেই প্রতিশোধ চাচ্ছিল। তারা এমন এক জীবন কামনা করছিলেন, যেখানে ভয় থাকবে না।
বাশারের বাবা হাফেজ আল-আসাদের শাসনকালে সিরিয়ার সাধারণ নাগরিকরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ফটকের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে দ্রুত চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, যাতে তারা আটক না হন এবং প্রেসিডেন্টের জন্য হুমকি হিসেবে তাদের জেলে না পাঠানো হয়।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে পৌঁছানোর মোবাইল ফোনগুলো কাজ করা বন্ধ করে যেত। প্রাসাদটি দামাস্কাসের পাহাড়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো এবং শহরের প্রায় প্রতিটি জায়গা থেকে সেটি দৃশ্যমান ছিল। এটি জনগণকে জানাতো যে আসাদরা সবসময় উপস্থিত এবং শাসনব্যবস্থার গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মাধ্যমে সবসময় দেখছে।
এই ব্যবস্থা ডিজাইন করেছিলেন হাফেজ, প্রথম আসাদ রাষ্ট্রপতি। তার সিক্রেট পুলিশ গোপনে একে অন্যের ওপর নজরদারি করত এবং জনগণের ওপরও নজর রাখত।
হোমস-এর একজন ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন, একটি গোয়েন্দা শাখা তাকে তার হোটেল উন্নয়নের সময় প্রথমে ডিজাইন চাইতে এসেছিল, যাতে তারা সেগুলোতে প্রয়োজনীয় সব রেকর্ডিং ডিভাইস যুক্ত করতে পারে। তারা বলেছিল, ভবনটি সম্পন্ন হওয়ার পর তাদের জন্য তা মাপসই করা তুলনামূলকভাবে কঠিন হত।
আসাদ পরিবার কখনও এই প্রাসাদে বসবাস করেনি। এটি আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো এবং এর ওপরে কিছু সাধারণ অফিস ছিল।
বাশার আল-আসাদ সিরীয় জনগণকে সংস্কারের কথা দিয়ে প্রলোভিত করছিলেন, যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। তিনি পশ্চিমা নেতাদেরও বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন, তিনি হয়ত ইরান থেকে আলাদা হতে পারেন। এবং যদি পশ্চিমা শিবিরে যোগ না-ও দেন, অন্তত এটুকু বুঝাতে পারতেন, তার পক্ষে বিরোধিতা না করা লাভজনক হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তাকে ইরান থেকে দূরে সরানোর জন্য চেষ্টা করেছিল।
বিকৃত ক্ষমতার চর্চায় আসাদ পরিবার সিরিয়াকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিল, নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছিল। তাদের অনুসারীদের কাছে পরিবারটি এমন এক সময়ে আস্থা কিনেছিল, যখন সিরিয়ার সাধারণ মানুষ নিয়মের বাইরে কিছু করলে বা কিছু না-ও করলে জেলখানায় বন্দি হতেন বা হত্যার শিকার হতেন।
আহমেদ নামের একজন যোদ্ধা ২০১১ সালে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন। দামাস্কাসে বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পর আইডলিবে ফিরে যান এবং হায়াত তাহরির আল-শামের বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করে আবার দামাস্কাসে ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, "মানুষেরা নরকের মতো জীবন কাটাচ্ছিল এবং সে (বাশার) তার প্রাসাদে ছিল।"
আহমেদ আরও বলেন, "তারা কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা নিয়ে তার কোনো চিন্তা ছিল না। সে তাদের ভয়, ক্ষুধা এবং অপমানের মধ্যে বাস করতে বাধ্য করেছিল। এমনকি আমরা দামাস্কাসে প্রবেশ করার পরও মানুষ শুধু আমাদের সঙ্গে ফিসফিস করত, কারণ তারা তখনো ভয় পেত।
বাশার আল-আসাদের বাবা, হাফেজ আল-আসাদ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের একজন ক্ষমতাধর নেতা। তিনি একজন নির্দয় মানুষ ছিলেন, যিনি পুলিশ রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন এবং সিরিয়ায় ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রায় পঁচাশি বছর ভয়, চালাকি এবং যে কোনো হুমকি ধ্বংস করার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করেছিলেন।
বাশার তার বাবার চেয়ে অনেক বেশি সিরীয়কে হত্যা করেছিলেন এবং দেশের পুরো কাঠামো ভেঙে ফেলেছিলেন তার শাসনব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য।
কিন্তু বাশারের জেদ, সংস্কার বা আলোচনা করতে অস্বীকৃতি এবং হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা বজায় রাখার প্রবণতা তার পরিণতি নির্ধারণ করেছিল এবং তাকে তার পরিবারসহ সিরিয়া থেকে মস্কো পালানোর সময় এক ভয়াবহ যাত্রায় ঠেলে দিয়েছিল।