ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে আমরা কী জানি?

পাঁচ মাস আগে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার স্বৈরাচারী নেতারা পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ও সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি সাক্ষর করেছেন। স্নায়ু যুদ্ধের পর তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে এ চুক্তি।
তাই ইউক্রেনে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সহায়তা করবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আড়াই বছর আগে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পুতিন। এরই মধ্যে প্রায় ছয় লাখ রাশিয়ান সৈন্য হতাহত হয়েছে।
গত শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, ইতোমধ্যেই রাশিয়ার জাহাজে করে এর মাসের শুরুতেই উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা আসতে শুরু করেছে। গতকাল মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, "উত্তর কোরিয়া হাজার হাজার সৈন্যকে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করছে।
যদিও মস্কো ও পিয়ংইয়ং এ দাবিগুলো অস্বীকার করেছে। তাছাড়া উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছে এমন কোনো শক্ত প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
উত্তর কোরিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী রয়েছে। তাদের এখন পর্যন্ত এক দশমিক দুই মিলিয়ন সেনা সদস্য রয়েছে। কিন্তু ১৯৫০-৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের পর তারা আর কোনো বড় সংঘর্ষে জড়ায়নি। কয়েক দশক ধরে পিয়ংইয়ং দাবি করে এসেছে, তারা কোরিয়া উপদ্বীপে যুদ্ধ প্রতিরোধে এ সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়েছে। ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে সেনাবাহিনী পাঠালে এটি তাদের জন্য বিদেশি যুদ্ধে প্রথম হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হবে।
উত্তর কোরিযা কীভাবে রাশিয়াকে সাহায্য করছে?
কিম ও পুতিন গত বছর দু'বার বৈঠক করেছেন। গত জুনে পিয়ংইয়ংয়ে চুক্তি সাক্ষর করেছেন পুতিন। এর মাধ্যমে তিনি রাশিয়ার ক্ষয়িষ্ণু অস্ত্রের মজুদ পূরণে কিমের সহায়তা নিবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তর কোরিয়া ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে রাশিয়ায় ১৩ হাজারের বেশি শিপিং কনটেইনার পাঠিয়েছে। এসব কন্টেইনারে করে আর্টিলারি রাউন্ড, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রকেট ও কেএন-২৩ স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। আর এসব পরিচালনায় প্রযুক্তিবিদসহ অফিসারদেরও পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া।

দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস গত শুক্রবার বলেছে, রুশ নৌবাহিনীর জাহাজে করে গত ৮ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবরের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার ১৫০০ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ অপারেশনাল বাহিনীকে রাশিয়ার বন্দর শহর ভ্লাদিভোস্টকে আনা হয়েছে। তখন ওই সেনাদের উসুরিস্ক, খবরভস্ক এবং ব্লাগোভেশচেনস্ক শহরের গভীরে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থার মতে, ওই সৈন্যদের রুশ সামরিক বাহিনীর ইউনিফর্ম ও অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তাদের ভুয়া পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে তারা নিজেদের পূর্ব সাইবেরিয়ার মানুষ বলে পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু ওই অঞ্চলের আদিবাসী বুরিয়াত ও ইয়াকুতদের মুখের বৈশিষ্ট্য অনেকটা এশিয়ানদের মতো বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
দক্ষিণ কোরিয়া সম্প্রতি স্যাটেলাইট ছবিও প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়া যেটিকে রুশ জাহাজ বলছে সেটি উত্তর কোরিয়ার বন্দরে আশেপাশে ঘুরছে এবং গত উসুরিয়স্ক এবং খাবারভস্কে শত শত উত্তর কোরিয় সৈন্য জড়ো হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, "সৈন্যদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রশিক্ষণ শেষ হলে তাদের ফ্রন্ট লাইনেই মোতায়েন করা হবে।"
তারা আরও বলেছে, "যুদ্ধের জন্য উত্তর কোরিয়া রাশিয়ায় আরও সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত। সম্প্রতি পিয়ংইয়ং ও ভ্লাদিভোস্টকের মধ্যে ঘন ঘনই বিমান চলাচল দেখা যাচ্ছে।"
উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া কী চায়?
ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে রাশিয়া যে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে চায় পুতিন।
রাশিয়াকে প্রকাশ্যে সমর্থন করা দেশগুলোর মধ্যে উত্তর কোরিয়া একটি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় ব্যর্থতার পর এমন সমর্থন কিমের জন্য নতুন পথ নির্ধারণে বিরল সুবিধা প্রদান করছে।
তাছাড়া কিমের সামরিক সমর্থনের বিনিময়ে পুতিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্তর কোরিয়ার ওপর নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যেকোনো প্রচেষ্টায় ভেটো দেবেন এবং বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলোকে দুর্বল করতে সহায়তা করবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বলছে, উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে তেল পাচ্ছে। যার কারণে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
তবে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা কাটাতে পুতিন সহায়তা করবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। যদিও উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে এবং বেশ কয়েকটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে। কিন্তু এখনও তাদের কোনো ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ্যভেদ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
কিছু বিশ্লেষকরা বললছেন, "রাশিয়াকে সহায়তা করার জন্য উত্তর কোরিয়ার সেনা পাঠানোরে এ তরিকা কয়েক দশক আগে দক্ষিণ কোরিয়া নিয়েছিল।"
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বাহিনী হয়ে সিউল তিন লাখ ২০ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিল। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে সহায়তা করেছিল। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সহজ ঋণের মাধ্যমে মিত্রদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল।
বিশ্ব কীভাবে সাড়া দিচ্ছে?
যদিও মস্কো এবং পিয়ংইয়ং অস্ত্র চুক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়ার সৈন্য মোতায়েনের খবর, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড জে. তৃতীয় অস্টিনসহ পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, যদি এটি হয়ে থাকে তবে তাদের সম্পর্কে এটি একটি ভালো উন্নতি। ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট সতর্ক করে বলেছিলেন, এ পদক্ষেপ বিদ্যমান উত্তেজনা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করবে।"
আর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আসবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। কারণ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাব বেড়ে চলছে। মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ককে একটি গুরুতর নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছে সিউল। তাছাড়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা জাতিসংঘের নিয়মের লঙ্ঘন বলে মনে করছে দক্ষিণ কোরিয়া।
গত মঙ্গলবার কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউন সুক সিউলের কার্যালয় থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, "উত্তর কোরিয়া তাদের তরুণদের অযৌক্তিক যুদ্ধে ভাড়াটে সৈনিক হতে বাধ্য করছে।"
তারা সতর্ক করেছে, "মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান 'সামরিক চুক্তি'র প্রতিক্রিয়ায় তারা পালটা ব্যবস্থা নিতে পারে।" গত মঙ্গলবার দক্ষিণ কোরিয়ার এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, পালটা প্রতিক্রিয়া জানাতে তারা ইউক্রেনে প্রতিরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক অস্ত্র পাঠাতে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত সিউল ইউক্রেনের প্রতি মানবিক ও আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি নন-লেথাল সামরিক সরঞ্জাম, যেমন- মাইন ডিটেক্টরের, সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়াকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া বিনিময়ে রাশিয়ার সামরিক সমর্থনের আশা করছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধ বাঁধলে মস্কোর সাহায্য সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সিউলের আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের একজন সিনিয়র বিশ্লেষক চা ডু হাইওগনের মতে, পিয়ংইয়ংয়ের সাথে সামরিক সম্পর্ক গভীর হওয়ার অর্থ হল, রাশিয়া এখন উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশকে সমস্যা নয় বরং একে গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়ে এর কাজ করবে।