ট্রাম্প ও পুতিন কেন আলাস্কায় বৈঠক করছেন? কখন এ বৈঠক?

আগামী শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৈঠক করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনা হবে। খবর বিবিসি'র।
গত শুক্রবার ট্রাম্প এই বৈঠকের ঘোষণা দেন। ওইদিনই ছিল রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য তার দেওয়া স্বঘোষিত সময়সীমার শেষ দিন। নতুবা রাশিয়ার ওপর আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেন তিনি।
এই গ্রীষ্মে ট্রাম্পের উদ্যোগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তিন দফা বৈঠক হয়েছে, কিন্তু শান্তি আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আলাস্কায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। একসময় রাশিয়ার অধীনে থাকা এই জায়গাটি ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
পুতিন ও ট্রাম্প কেন সাক্ষাৎ করছেন?
ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও তেমন সফল হননি ট্রাম্প।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন।
তিনি বারবার দাবি করেছেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার সময় তিনি যদি প্রেসিডেন্ট থাকতেন, তাহলে এই যুদ্ধ 'কখনোই শুরু হতো না'।
গত মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, তিনি পুতিনের প্রতি 'হতাশ'।
পরে তার ক্ষোভ বেড়ে যায় এবং ৮ আগস্টের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে পুতিনকে সময়সীমা বেঁধে দেন ট্রাম্প। পুতিন রাজি না হলে আরও কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেন।
কিন্তু সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ১৫ আগস্ট তিনি পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করবেন।
ট্রাম্পের বরাতে বলা হয়েছে, এর আগে বুধবার মস্কোতে মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে পুতিনের 'খুবই ফলপ্রসূ' আলোচনা হয়েছে।
ইউক্রেন কি বৈঠকে যোগ দিচ্ছে?
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্প একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসতে আগ্রহী, অর্থাৎ সেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও উপস্থিত থাকবেন।
তবে আপাতত এটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের অনুরোধে নির্ধারিত ট্রাম্প–পুতিন বৈঠক হিসেবেই থাকবে।
আলাস্কায় এই শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের খবরের প্রতিক্রিয়ায় জেলেনস্কি বলেছেন, কিয়েভের মতামত ছাড়া যেকোনো সমঝোতাই হবে 'মৃত সিদ্ধান্ত'।
শুক্রবার ট্রাম্প বলেন, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে সমঝোতার জন্য কিছু ভূখণ্ড বিনিময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এ বক্তব্যের জবাবে টেলিগ্রামে জেলেনস্কি লিখেছেন, 'রাশিয়া যা করেছে, তার জন্য আমরা কোনো পুরস্কার দেব না। আমাদের বিরুদ্ধে, আমাদের ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্তই শান্তির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত।'
রোববার ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, জেলেনস্কি পরে পুতিন ও ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে পারেন। তবে আপাতত ট্রাম্প ও পুতিনের আলাস্কায় বৈঠকের আগে জেলেনস্কির পুতিনের সঙ্গে দেখা করাকে তিনি 'গঠনমূলক' মনে করছেন না।
তিনি বলেন, 'মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেই এ দুজনকে একসঙ্গে আনতে হবে।'
দুই পক্ষ কী অর্জন করতে চায়?
ট্রাম্প শুক্রবার বলেছেন, 'হত্যা বন্ধের' চুক্তি প্রায় হয়ে এসেছে। যুদ্ধ থামাতে দুই পক্ষকে কী কী শর্ত মানতে হতে পারে, সে ব্যাপারেও তিনি কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশই বলছে, তারা যুদ্ধের অবসান চায়। কিন্তু প্রত্যেকেই এমন কিছু দাবি করছে, যা অপর পক্ষ কঠোরভাবে অস্বীকার করছে।
ইউক্রেন স্পষ্ট জানিয়েছে, রাশিয়ার দখলে থাকা অঞ্চল, বিশেষ করে ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়া হবে না। ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, 'এখানে আলোচনার কিছুই নেই। এটা আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী।'
এখন পর্যন্ত পুতিন তার দাবিগুলো থেকে সরে আসেননি। তার দাবির মধ্যে রয়েছে — ভূখণ্ড দখল বজায় রাখা, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা এবং দেশটির সামরিক বাহিনীর ভবিষ্যৎ আকার নিয়ে শর্ত।
রাশিয়া আক্রমণ চালানোর বড় কারণ হলো, পুতিন মনে করেন ইউক্রেনে পশ্চিমা প্রভাব বাড়ছে। তিনি অভিযোগ করেন, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে নিজেদের সেনা জড়ো করছে।
সিবিএস নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপের নেতাদের এমন এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে বলছে, যা রাশিয়াকে ইউক্রেনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেবে।

আলোচনায় সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া ক্রীমিয়া উপদ্বীপ দখল রাখবে এবং ইউক্রেনের পূর্বের দোনবাস অঞ্চল (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) নিয়ন্ত্রণ করবে।
২০১৪ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে ক্রীমিয়া দখল করে এবং দোনবাসের বেশির ভাগ অংশে তাদের সেনাবাহিনী রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, রাশিয়াকে খেরসন ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চল ছাড়তে হবে, যেখানে এখন তাদের সামরিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, 'কিছু কিছু এলাকা বিনিময় হবে, যা দুই পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।'
ফক্স নিউজের সাক্ষাৎকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স বলেন, 'ভবিষ্যতের কোনো চুক্তি কারো খুব ভালো লাগবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'এখানে শান্তি করতে হবে... দোষারোপ চলবে না। শান্তির জন্য দরকার একজন বলিষ্ঠ নেতা, যিনি বসবেন এবং সবাইকে একত্রিত হতে বাধ্য করবেন।'
ট্রাম্প এবং পুতিন কোথায় বৈঠক করবেন?
শুক্রবার সন্ধ্যায় ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ জানিয়েছেন, তার ও পুতিনের মধ্যে 'বহুল প্রত্যাশিত' একটি বৈঠক ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে 'মহান আলাস্কা রাজ্যে'। তিনি আরও জানিয়েছেন, বৈঠকের স্থান 'বিভিন্ন কারণে খুব জনপ্রিয় একটি জায়গা' হবে।
তবে আলাস্কায় বৈঠকের সঠিক জায়গা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
তারা কেন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা বেছে নিলেন?
যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেয়। তাই এই বৈঠকের জন্য এই জায়গার একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে।
রুশ রাষ্ট্রীয় সহকারী ইউরি উশাকভ বলেছেন, এই স্থান 'খুবই যুক্তিসঙ্গত' এবং দুই দেশ প্রতিবেশী, বেরিং সাগর তাদের বিভক্ত করেছে।
উশাকভ বলেন, 'আমাদের প্রতিনিধিদলের জন্য বেরিং সাগর পাড়ি দিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যাশিত শীর্ষ সম্মেলন আলাস্কায় হওয়া স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।'
সবশেষ আলাস্কা মার্কিন কূটনৈতিক আলোচনার জন্য গুরুত্ব পেয়েছিল ২০২১ সালের মার্চ মাসে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা দল চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অ্যাঙ্করেজে বৈঠক করেছিল।
ওই বৈঠক বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেখানে চীন আমেরিকানদের 'অহংকার ও ভণ্ডামির' দায়ে অভিযুক্ত করে।