দেশের নাম কেন পরিবর্তন করা হয়?

পৃথিবীজুড়ে নানা দেশের সরকার সম্প্রতি শত শত শহর, রাস্তা, পাহাড়, ন্যাশনাল পার্ক ইত্যাদির নাম পরিবর্তন করেছে। আগামীতে হয়তো দেশে দেশে একই প্রবণতা আরও বেশি দেখা যাবে। জায়গার নাম নানা কারনে পরিবর্তন করা হয়। হয়তো অনেক সময় কুখ্যাত কোনো নেতার নাম মুছে দিতে। কিংবা কখনো পূর্বের নেতিবাচক ইতিহাস ভুলে নতুন করে সব শুরু করতে। নামের এই পরিবর্তনগুলি যদিও প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। প্রায়শই তৈরি করে বিতর্কও। খবর বিবিসির।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার পুরো দেশের নামই পরিবর্তন হয়। গত বছর তুরস্ক বানানের দিক থেকে নিজেদের নাম পরিবর্তন করেছে। এই নাম পরিবর্তনের একটি কারণ ছিল, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দেশটির নামের সাথে একটি পাখির নাম মিলে যাওয়ার বিষয়টিকে অপছন্দ করেছিলেন।
২০১৮ সালে 'দ্য আফ্রিকান ন্যাশন অফ সোয়াজিল্যান্ড' ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৫০ বছর উদযাপন করেছে। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশটি নাম পরিবর্তন করে ইসোয়াতিনি রাখে। সোয়াজি ভাষায় যার নাম 'ল্যান্ড অফ দ্য সোয়াজি পিপল'।
এমনকি নাম পরিবর্তনের দিক থেকে পিছিয়ে নেই বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ ইন্ডিয়াও। গত কয়েক দশকে দেশটি বেশ কয়েকটি স্থানের উপনিবেশিক ও মুসলিম নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম দিয়েছে। এরমধ্যে মাদ্রাসের নাম চেন্নাই, ক্যালকাটার নাম কোলকাতা, ব্যাঙ্গালোরের নাম বেঙ্গালুরু, আল্লাহাবাদের নাম প্রয়াগরাজ করা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি দেশটির নামই পরিবর্তন করে ফেলার আভাস দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে ইন্ডিয়া যদি সুদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব পরিমন্ডলে 'ভারত' হিসেবে পরিচিতি পায় তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কেননা চলতি বছর নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে মোদির সামনে থাকা দেশের নেইমপ্লেটে ইন্ডিয়া নয়, বরং 'ভারত' লেখা ছিল। একইসাথে অতিথিদের ভোজসভায় আমন্ত্রণ করা কার্ডে লেখা ছিল 'প্রেসিডেন্ট অফ ভারত'।
ইন্ডিয়ার নাম পরিবর্তনের মোদির প্রচেষ্টা এখনো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। তবে এটা সত্যি যে, একটি দেশের অফিসিয়াল নাম পরিবর্তন করা সহজ নয়। বরং সেটি বেশ ব্যয়বহুল এবং সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
দেশটিকে অবশ্যই নাম পরিবর্তনের অনুরোধ করে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠাতে হবে। একইসাথে সংস্থাটির অফিসিয়াল ছয়টি ভাষায় কীভাবে নামটি লেখা হবে ঐ বিষয়ে পরামর্শ দিতে হবে।
জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিত হলে সেখানকার অফিসিয়ালরা 'ওয়ার্ল্ড জিওগ্রাফিকাল নেইমস' নামের যে ডেটাবেইজ রয়েছে সেটিতে রেজিস্টার করাবে। সেক্ষেত্রে নানা প্রতীক, সামরিক ইউনিফর্ম, সরকারী মুদ্রা, সরকারী লেটারহেড ইত্যাদি নানা কিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে।
জায়গার নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটা বর্তমানে বেশ আলোচিত হলেও এমন প্রবণতা নতুন নয়। বরং বহুকাল আগে থেকেই প্রতিনিয়ত জায়গার নাম পরিবর্তন করা হতো। পঞ্চম শতাব্দীর আগে বিখ্যাত শহর প্যারিস 'লুটেটিয়া' নামে পরিচিত ছিল। ১৬৬৫ সালের আগে নিউ ইয়র্কের নাম ছিল 'নিউ আমস্টারডাম'।
১৭৯৩ থেকে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত টরোন্টো 'ইয়র্ক' নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬৮ সালের আগ পর্যন্ত টোকিও 'এডো' নামে পরিচিত ছিল। আর ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত শহর কনস্টান্টিনোপলের নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুল রাখা হয়।
কিন্তু নাম পরিবর্তন কেন এত গুরুত্ব রাখে? স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশগুলি অনেক সময় নিজেদের নির্যাতিত ঔপনিবেশিক অতীত ভুলে নতুন করে শুরু করতে ক্ষেত্রবিশেষে নাম পরিবর্তন করে। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ কলোনি 'গোল্ড কোস্ট' স্বাধীনতা লাভ করলে দেশটির নাম অতিসত্বর পরিবর্তন করে ঘানা রাখা হয়।
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্ত হতে থাকে একেক অঞ্চল। তখন দেশগুলোর নাম পরিবর্তনেরও হিড়িক ওঠে। ১৯৭২ সালে 'সিলন' নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শ্রীলঙ্কা। আর ১৯৮৪ সালে 'আপার ভোল্টার' নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বুরকিনা ফাসো।
কিছু কিছু নাম পরিবর্তনের পেছনে আবার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। যেমন, ২০১৮ সালে মেসিডোনিয়ার নাম পরিবর্তন করে নর্থ মেসিডোনিয়া রাখা হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই পরিবর্তন বেশ সামান্য। তবে প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি এতটা সরল নয়। দেশটির এই নাম পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে গ্রীসের সাথে দীর্ঘ কয়েক দশকের দ্বন্দ্ব। কেননা গ্রীসেও একই নামে একটি অঞ্চল হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশটির নাম পরিবর্তনের ফলে বিবাদের সমাধান হয়েছে। একইসাহে নর্থ মেসিডোনিয়ার ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পথ সহজ হয়েছে।
যদিও খুব অল্প সংখ্যক মেসিডোনিয়ান্সই দেশটির নতুন নাম সচারাচর ব্যবহার করছে। আর এক্ষেত্রে একটা বিতর্ক নতুন করে সামনে এসেছে। একটি দেশের নাম পরিবর্তনের পরেও যদি সেটি সচারাচর মানুষের মুখে ব্যবহৃত না হয়, সেক্ষেত্রে দেশটির নাম প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তন হয়েছে বলে বলা যাবে কি?
ভিয়েতনামের বহু মানুষ এখনো সাইগনকে 'হো চি মিন সিটি' নামেই ডাকে। বহু ভারতীয় আবার মুম্বাইকে সেই 'বোম্বে' বলে থাকে। লেখক লিয়া মেহতা ঠিক তেমনি একজন। তিনি বলেন, "আমি এবং আমাদের প্রজন্ম সত্যিই নাম পরিবর্তনের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছি। এমনভাবে নাম পরিবর্তনের কোনো মানে হয় না।"
লিয়া মেহতা এখনো বলেন যে, তিনি বোম্বের অধিবাসী। তখন কোনো বিদেশি হয়তো নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করেন যে, "আপনি কি মুম্বাইয়ের কথা বলছেন?" ভারতীয়রা অবশ্য ঐ বিদেশীদের সাথে এই ব্যাপারে খুব একটা আলাপে যান না। তবে বোম্বের নাম যে পুরোপুরি মুছে গেছে তেমনটাও নয়। বরং এখনো শহরটির স্টক এক্সচেঞ্জ ও হাইকোর্টের নামে মুম্বাইয়ের পরিবর্তে বোম্বে ব্যবহার করা হয়।
এক্ষেত্রে চেক রিপাবলিকের প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশটি ২০১৬ সালে নাম পরিবর্তন করে 'চেকিয়া' রেখেছে। কিছু চেক কর্মকর্তারা মনে করেন, নতুন নামটি আরও ভালো শোনায়।
নাম পরিবর্তন সম্পর্কে ঐ সময়টাতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুবোমির জাওরালেক চেক নিউজ এজেন্সিকে বলেন, "একটি দেশের স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা প্রতীক বা নাম না থাকার বিষয়টি ভালো নয়।"
অন্যদিকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিশ ২০২০ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম পরিবর্তনের বিষয়ে বলেন, "আমি ঠিক জানি না যে, কে বা কারা এই বাজে আইডিয়াটি নিয়ে এসেছে।"
জোরপূর্বক একটি স্থানের নাম পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই বেশ বিতর্ক ও মতানৈক্যর সৃষ্টি করে। কেননা জায়গার নামের সাথে জড়িত থাকে ইতিহাস; স্থানীয় মানুষের আবেগ ও অজস্ত্র স্মৃতি। এক্ষেত্রে নৃতত্ত্ববিদ টমাস এরিকসেন মনে করেন যে, ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ঐতিহাসিক স্থানের নাম পরিবর্তন করার কাজটি বেশ নাটকীয় কাজ; যা বিতর্ক এবং মতবিরোধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ভালো কিংবা খারাপ উভয় দিক থেকেই একটি জায়গার নাম ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারে। প্রায় চারশত বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের নাম অফিসিয়ালি 'স্টেট অফ রোড আইল্যান্ড এন্ড প্রভিডেন্স প্লান্টটেশন'। ২০২০ সালে সেখানকার বাসিন্দারা রাজ্যটির নাম শুধু 'রোড আইল্যান্ড' রাখতে ভোট প্রদান করেন। এ সম্পর্কে স্টেট সিনেটর হ্যারল্ড মেটস মনে করেন, পুরনো নামটি মার্কিন জাতির ইতিহাসের ট্র্যাজিক এবং বর্ণবাদী সময়ের ভয়ঙ্কর অর্থ বহন করে।
মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি অবমাননাকর ভৌগলিক নাম পরিবর্তনে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। যেটি দেশটির শত শত হ্রদ, পর্বতশৃঙ্গ ইত্যাদির নাম পরিবর্তন করছে। তেমনি একটি নাম 'স্কোয়াও'; যা নারী নেটিভ আমেরিকানদের জন্য একটি অবমাননাকর শব্দ।
একইভাবে নিউজিল্যান্ডেও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের নাম পরিবর্তন করে 'আওতেরোয়া' রাখার দাবি উঠেছে। মাওরি ভাষায় যার অর্থ 'দীর্ঘ সাদা মেঘ'।
কখনও কখনও জায়গার নাম পরিবর্তনের সাথে স্থানীয় কিছু বিষয়ও জড়িত থাকে। যেমন ১৯৯০ এর দশকে যখন 'ডট-কম' বাবল বেশ তুঙ্গে; তখন অরিগনের হাফওয়ে শহরের নাম পরিবর্তন করে 'হাফ.কম' রাখা হয়। মূলত এটি ছিল একটি ই-কমার্স কোম্পানির নাম। একইভাবে সড়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে অস্ট্রেলিয়ার শহর 'স্পিড' এর নাম পরিবর্তন করে 'স্পিডকিলস' রাখা হয়।
জায়গার পুরানো নাম ফিরে আসারও নজির রয়েছে। ১৬২৪ সালে আগুনে অসলো শহরের অধিকাংশ অংশই পুড়ে গিয়েছিল। তখন শহরটির তৎকালীন শাসক রাজা ক্রিস্টিয়ান চতুর্থ নতুন করে গড়ে তোলা শহরটির নাম 'ক্রিস্টিয়ানা' রাখার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও স্বাভাবিকভাবেই রাজা নিজে বাদে অন্য কারও কাছে এই নামটি খুব একটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। ১৯২৫ সালে শহরটির নাম ফের অসলো রাখা হয়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে রুশ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পেট্রোগ্রাদ। ২০১৪ সালে ভ্লাদিমির লেলিনের সম্মানে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লেলিনগ্রাদ। আর সর্বশেষে ১৯৯১ সালে শহরটি সেই আগের সেন্ট পিটার্সবার্গ নামটিই ফিরে পায়।
নাম পরিবর্তনের দিক থেকে কাজাখস্তান যেন সকলকে হার মানিয়েছে। কেননা দেশটির রাজধানীর গত ছয় দশকে মোট পাঁচবার নাম পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৬১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নানা সময়ের আস্তানার নাম ছিল আকমোলিনস্ক, সেলিনোগ্রাদ, আকমোলা, নুর সুলতান ইত্যাদি।