ফিলিস্তিনি বন্দী মারাহ বাকের যেভাবে ইসরায়েলি কয়েদখানা থেকে পরিবারের কাছে

চোখ মুছতে মুছতে, সম্পূর্ণ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে সাওসান বাকের নামছে নিজ বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে। চোখেমুখে যেন অজস্র আনন্দ। কেননা তার ২৪ বছর বয়সী কন্যা মারাহ বাকের আট বছর পর মুক্ত হয়েছেন। এতদিন ইসরায়েলি কয়েদখানায় বন্দী ছিলেন তিনি।
মারাহ ৩৯ জন ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুর মধ্যে একজন, যাদেরকে গত শুক্রবার ইসরায়েলি সরকার মুক্ত করেছে। অবশ্য চুক্তির অংশ হিসেবে হামাসের কাছে থাকা ইসরায়েলি বন্দীদের মধ্যে ১৩ জনকেও মুক্ত করা হয়েছে। এটিতে পুরোপুরিভাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে কাতার; যাতে রয়েছে চলমান চারদিন ধরে যুদ্ধবিরতির বিষয়টিও।
নিজের কন্যাকে কাছে পেয়ে মা সাওসান সাংবাদিকদের উচ্ছ্বাসের সুরে বলেন, "আমি আপনাদেরকে বলেছিলাম যে, মারাহ বেশ সুন্দর। ও আমার মেয়ে বলে বলছি না কিন্তু। আসলেই ও বেশ সুন্দর। এখন আপনারাই দেখুন।"
জেলে বন্দী হওয়ার আগে মারাহ ছিলেন ১৬ বছর বয়সী এক স্কুল শিক্ষার্থী। তিনি দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-মাইমুনা স্কুলে পড়াশোনা করতেন।
মারাহ প্রতিদিন পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেমের মাঝে অবস্থিত একটি এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রম করে বেইত হানিনায় নিজের বাড়ি থেকে স্কুলে যেতেন। ২০১৫ সালে ১২ অক্টোবর একইভাবে তিনি স্কুলে যাচ্ছিলেন। তখন ইসরায়েলি বাহিনীর একজন সেনা সদস্যকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টার অভিযোগে তাকে গুলি ও গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও মারাহ ও তার পরিবার বরাবরই এমন অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
যখন মারাহকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তার হাতে প্রায় ১২ টি গুলির আঘাত লেগেছিল। তিনি আহত অবস্থায় ফুটপাথের উপর শুয়ে ছিলেন। ছুরিকাঘাতে চেষ্টার অভিযোগে তাকে আট বছর ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যেহেতু মারাহ গ্রেফতারের সময় বয়স বিবেচনায় একজন শিশু হিসেবে গণ্য ছিল, তাই মাত্র চারমাস সাজা খেটেই তার বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে ফিরেছে বহু বছর পর, তাও চলমান জটিল এক চুক্তির অধীনে।
বন্দী দশা থেকে মুক্ত হয়ে আল-জাজিরাকে মারাহ জানান, জেলে থাকার সময়টি বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু তিনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে এটা সহ্য করেছেন। একইসাথে এই যাত্রায় তার পরিবার এবং সহকর্মী ফিলিস্তিনি বন্দীদের সমর্থন পেয়েছিলেন।
মারাহ বলেন, "কারাগারের জীবন অনেক কঠিন। কিন্তু অন্য যারাই এই জীবনের মধ্য দিয়ে গেছে, তারাও কোনো না কোনোভাবে এটি পার করেছে। তবে কারাগার আমার জন্য বিশেষভাবে কঠিন ছিল; কারণ আমি ছোট ছিলাম।
মারাহ আরও বলেন, "যখন আমি জেলে ছিলাম তখন আমার মায়ের ভালোবাসা এবং আমার পরিবারের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। যদিও কারাগারে থাকা অন্য বন্দীরা আমার যত্ন নিয়েছেন এবং আমাকে সাহায্য করেছেন। তবে কিছুই মায়ের ভালবাসাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।"
বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের জেলে বন্দী রয়েছেন। যাদের মধ্যে ৩ হাজার জনকে গত দেড় মাস ধরে চলা যুদ্ধের সময় গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে চলমান চার দিনের যুদ্ধবিরতিতে ১৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী ও ৫০ জন ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে।
কারাগারে থাকাকালীন গত কয়েক বছর ধরে মারাহ যেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিল। তিনি যেন উত্তর ইসরায়েলের ড্যামন কারাগারে সকল নারী বন্দীদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে মারাহ ও কারাগারের অন্যান্য নারী নেত্রীদের জালামে অবস্থিত আরেকটি কারাগারে স্থানান্তর করে ইসরায়েল। একইসাথে তাদেরকে একাকী সেলে বন্দী করে রাখা হয়।
প্রায় সাত সপ্তাহ সময় ধরে মারাহকে তার সাথে থাকা বন্দীদের সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। একইসাথে বাইরের বিশ্বে আসলে কী ঘটছে সেটি সম্পর্কে জানতে দেওয়া হয়নি।
আল জাজিরাকে মারাহ বলেন, "যুদ্ধের সময়টি বেশ কঠিন ছিল। কারণ তারা আমাকে বাকিদের থেকে দূরে রেখেছিল। আমি জানতাম না তাদের সাথে কী ঘটছে এবং এটি সত্যিই আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিল, আমি আমার পরিবারের সম্পর্কে কিছু জানতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি জানতাম যে, আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করবেন।"
গত বুধবার মারাহকে সেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সে যে মুক্ত হচ্ছে, এমন কিছুই তাকে জানানো হয়নি। তিনি বলেন, "যখন আমাকে আমার সেলে ফিরিয়ে নেওয়া হল না, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির বিস্তারিত সম্পর্কে আমার জানা ছিল না।" পরবর্তীতে গত শুক্রবার সকালে জানানো হয়, তাকে মুক্ত করা হচ্ছে।
মারাহ ঠিক কবে নাগাদ বাড়িতে পৌঁছাবে সেটি সম্পর্কে তার পরিবারও নিশ্চিত ছিলেন না। তবে তার আগমনে কোনো আনন্দ বা উদযাপন করার বিরুদ্ধে পরিবারটিকে সতর্ক করেছিল ইসরায়েল।
মারাহের বাবা জাওদাতকে জেরুজালেমের একটি থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার মুক্তি নিয়ে কোনো আনন্দ না দেখানোর বিষয়ে পরিবারটিকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আল-জাজিরাকে জাওদাত বলেন, "বাকের আজ বাড়িতে এসেছে। আমরা এইমাত্র তাকে পেয়েছি। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী হুমকি দিয়েছিল যে, আমরা তার মুক্তি উদযাপন করলে তারা বাড়িতে হামলা চালাবে এবং আমাকে গ্রেপ্তার করবে।"
ইসরায়েলি বাহিনী মারাহের বাড়ির আশেপাশের সমস্ত প্রবেশ পথও বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বাড়ির সামনে সৈন্য মোতায়েন করেছে, যাতে কেউ জড়ো হতে না পারে।
ফিলিস্তিন প্রিজনার্স ক্লাব নামের এক এনজিওর প্রধান কাদিরা ফারেস জানান, পশ্চিম তীরের ৩৩ জন বন্দীকে মুক্ত করা হয়েছে এবং রেড ক্রসের একটি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য ছয়জনকে জেরুজালেমে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
এনজিওটি এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দী এবং তাদের পরিবারকে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলা, বাড়িতে অতিথিদের রাখা কিংবা উদযাপনের অংশ হিসেবে মিষ্টি বিতরণ করা থেকে নিষেধ করাসহ বেশ কয়েকটি শর্ত বেঁধে দিয়েছে। যারা এই নিয়ম মেনে চলবে না তাদের প্রায় ১৮,৭৪০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাড়িতে ফিরে আসায় নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বাকের বলেন, "মুক্ত হয়ে আমি অবশ্যই খুব খুশি। কিন্তু গাজায় আমাদের ভাই-বোনদের জীবনের মূল্যে এই চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই আমি বিধ্বস্ত বোধ করছি।"
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলের ১২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তার পর থেকে টানা দেড় মাসের মতো সময়ে গাজায় ক্রমাগত বোমা হামলা করেছিল ইসরায়েল। এই বোমা হামলায় উপত্যকাটিতে অন্তত প্রায় ১৪,৮০০ মানুষ নিহত হয়েছে।