বগুড়া থেকে ব্রিটেন: স্থানীয় অটো ফিল্টার যাচ্ছে বিশ্ববাজারে

আন্তর্জাতিক বাজারে 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা ফিল্টার আরও একবার নিজের শক্ত অবস্থানের জানান দিল। বগুড়াভিত্তিক কার ফিল্টার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বগুড়া মটরস লিমিটেড গতবছর ১১,২৫০ মার্কিন ডলারের ফিল্টার রপ্তানি করেছে যুক্তরাজ্যে।
সম্ভবনাময় এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানটি এখন স্পেন, পর্তুগাল, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির দুয়ার উন্মোচনের পরিকল্পনা করছে। একইসঙ্গে, দেশে পাওয়ার প্ল্যান্টের ফিল্টারের বাজার ধরতে বগুড়ায় তারা নতুন আরেকটি কারখানাও স্থাপন করতে যাচ্ছে।
কোম্পানিটি ২০০৭ সালে প্রথম কানাডায় ফিল্টার রপ্তানি করে; তবে কানাডার বাজারে উল্লেখযোগ্য চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচের কারণে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
এই কোম্পানির ফিল্টারসহ বগুড়া থেকে গত বছরে রপ্তানি হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৬০৭ কোটি টাকার ওপরে। দেশ তথা উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে এই রপ্তানি আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
বগুড়া মটরস ইঞ্জিন ফিল্টার তৈরিতে তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে গত ৩০ বছর ধরে। দেশে ও বিদেশে তাদের তৈরি এয়ার, ওয়েল এবং ফুয়েল- এই তিন ধরনের ফিল্টারের চাহিদা রয়েছে। উভয় জায়গায়ই সুনামের সাথে ব্যবসা করে আসছে তারা। মানসম্পন্ন ফিল্টারের কারণে দেশের বাজারেও ক্রমাগত চাহিদা বাড়ছে। ফলে সঙ্গত কারণেই সক্ষমতা বাড়াতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা পাওয়ার ফিল্টার তৈরিতে বগুড়া মটরস কারখানায় ১২৬ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এই ফিল্টার মোটরসাইকেল থেকে দেশের সব ধরনের গাড়িতে ব্যবহার করা যায়।
১৯৬৫ সালে বগুড়ার বিসিক শিল্প নগরী (বিসিক) এলাকায় দুই বিঘা জমিতে শুরু হয় বগুড়া মটরসের যাত্রা। প্রথমে এখানে পুরাতন মোটরগাড়ি মেরামত করা হতো। মূলত ইঞ্জিনের ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট-এর কাজ হচ্ছিল। পরে চাহিদার প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালে ব্যবসার ধরন পাল্টে ফিল্টার তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়। লক্ষ্য নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক মানের ফিল্টার তৈরি করার।
প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান পরিচালক ডা. তাহমিদুল ইসলাম জানান, দেশে সেনাবাহিনী, বিজিবি, প্রাণ আরএফএফ কোম্পানিসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানে পাওয়ার ফিল্টারের চাহিদা ব্যাপক।
২০০৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও) থেকে সনদ পাওয়ার পর ২০০৭ সালে বিশ্ববাজারে এই ফিল্টার পরিচিতি লাভ করে। ওই বছর কানাডায় রপ্তানি করা হয় পাওয়ার ফিল্টার। কিন্তু চাহিদা থাকলেও উৎপাদন খরচে বেড়ে যাওয়ায় কানাডায় ফিল্টার রপ্তানি বন্ধ রাখা হয়।
তবে এখন হিসাব বদলে গেছে বলে জানান ডা. তাহমিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের সামর্থের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুধুমাত্র তাদের প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ থেকে 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা ফিল্টার বিদেশে রপ্তানি করে।
এই পণ্য রপ্তানির জন্য তারা বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের কাছ থেকে সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়েছেন। এই সার্টিফিকেট থাকলে সেই পণ্য বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় বলে জানান ডা. তাহমিদুল।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের বগুড়ার উপমহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, দেশের বাজারে বগুড়া মটরসের উৎপাদিত পাওয়ার ফিল্টারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
"এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা বার্ষিক ২ লাখ পিস। তবে, এখন উৎপাদন করা হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার পিসের মতো। এখানে উৎপাদিত ফিল্টার আন্তর্জাতিক মানের; এটি নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তারা গত বছর যুক্তরাজ্যে ফিল্টার রপ্তানি করে দেশের সুনাম অর্জন করেছে," যোগ করেন তিনি।
বিশ্বমানের কাঁচামাল
ফিল্টার তৈরি করতে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি লাগে তা হলো, ফিল্টার পেপার। ফিল্টার পেপার বিভিন্ন মানের হয়ে থাকে। এসব পেপার কোরিয়া থেকে আমদানি করে বগুড়া মটরস।
ফিল্টার ভালো করতে গেলে কেসিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই কেসিং উত্তর কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয়।
আর এসব অ্যাসেম্বল করতে আঠা আমদানি করা হয় উত্তর কোরিয়া বা থাইল্যান্ড থেকে।
এছাড়া, প্লেন শিট লাগে অনেক বেশি পরিমাণে। এই পণ্য আমদানি করা হয় না। তবে জাপান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠান আমদানি করে। সেখান থেকে বগুড়া মটরস কিনে নেয়। রাবার ও প্লাস্টিকের দানা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয় করা হয়। কেসিংয়ের রং করা হয় এই প্রতিষ্ঠানেই।
বাজার দখলের প্রস্তুতি
দেশের বাজারে এখন পাওয়ার প্লান্টের ফিল্টারের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এ কারণে বগুড়া মটরস কাহালু উপজেলায় ৪ বিঘা জমিতে বড় পরিসরে ফিল্টার উৎপাদনে নতুন আরেকটি কারখানা নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
তাহমিদুল বলেন, "উদ্দেশ্য হল বড় পরিসরে পাওয়ার প্ল্যান্ট ফিল্টার তৈরি করা এবং এগুলোকে বিভিন্ন টার্গেট দেশে রপ্তানি করা; এইসঙ্গে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিশ্ববাজারে 'মেড ইন বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডের বিস্তার করাও আমাদের লক্ষ্য।"
বগুড়া মটরসের ব্যবস্থাপক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, এখানে ফিল্টারগুলো সাধারণত ইঞ্জিনের কাজে লাগে। বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ফিল্টার, জেনারেটরের ফিল্টার, কিছু কৃষি যন্ত্রপাতির ফিল্টার তৈরি করা হয়।
"যেখানে ইঞ্জিন ও তেলের কাজ আছে, সেখানে এই ফিল্টার কাজে লাগে। বিদেশে এই ফিল্টারের চাহিদা থাকলেও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে খুব সম্প্রতি নতুন কারখানার যাত্রা শুরু হবে," যোগ করেন তিনি।
এক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে এমন ফিল্টার তৈরি মোট ৮টি কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে বগুড়ায় চারটি; রাজশাহী, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে রয়েছে একটি করে এবং আরেকটি রয়েছে ঢাকায়।
দেশে চাহিদার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ফিল্টার এই ৮ প্রতিষ্ঠান উৎপাদন ও সরবরাহ করে।
এই ৩০ শতাংশ চাহিদার অধিকাংশই পূরণ করে বগুড়া মটরসের পাওয়ার ফিল্টার। এখানে প্রায় ৪০০ রকমের ফিল্টার তৈরি করা হয়। মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে কমপ্রেসার ইঞ্জিনের বড় ফিল্টার এখানে তৈরি করা হয়। সবচেয়ে ছোট ফিল্টার মোটরসাইকেলের; এর দাম ৭০ টাকা থেকে শুরু। আর বড় ফিল্টারের দাম ২,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
ডা. তাহমিদুল ইসলাম জানান, দেশে বর্তমানে উৎপদিত ফিল্টারের গায়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখে না। সাদা ফিল্টার বিক্রি করে। আর এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে একটি অসাধু চক্র। তারা দেশে উৎপাদিত ফিল্টারের গায়ে 'মেড ইন জাপান' বা 'কোরিয়া' বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
"তবে আমরা 'মেড ইন বাংলাদেশ'কেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাই," বলেন তিনি।
এক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি বাড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলেও উল্লেখ করেন ডা. তাহমিদুল।
এছাড়া গত এক বছর ধরে কাঁচামাল আমদানি ওপর ভ্যাট নির্ধারণ নিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, এখন কাঁচামাল আমদানির সময় বন্দরেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট কেটে নেওয়া হয়। এটি দিয়ে কিছু তৈরি হলো কিনা সেটি দেখা হয় না।
অগ্রীম ভ্যাটের কারণে অনেক টাকা সেখানে আটকে যাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে সরকারের একটু শিথিলতা দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সামনে সুদিনের অপেক্ষায় বগুড়া
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, জাতীয় অর্থনীতিতে ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বগুড়া।
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ আর বগুড়া বিমানবন্দর হলে এই অঞ্চলে বহু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। তখন বগুড়া মটরসের মতো আরও বহুমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে বলে জানান তিনি।