দীর্ঘ লকডাউন: মৎস্য খাতে অশনি সংকেত

দেশের প্রাণীজ আমিষের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ যোগান দেয় মৎস্য সম্পদ। জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ, মাছ চাষ এবং এ সম্পর্কিত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেশে বদ্ধ জলাশয়ে উৎপাদন হয় প্রায় ২৪ লাখ টন মাছ।
কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তাতে চলতি মৌসুমে চাষের শুরুতেই সঙ্কটের মুখে পড়েছে মৎস্য শিল্প। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই সঙ্কটের কারণে আগামী মৌসুমে মৎস্য উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। ঘাটতি থাকতে পারে দেশের প্রাণীজ আমিষের চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবহন সমস্যার সমাধান ও মৎস্য খাতের প্রকৃত উদ্যোক্তাদেরকে সরকার ঘোষিত পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের অর্থ দ্রুত দেওয়া হলে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব।
মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু মাছ চাষের মৌসুম। এ সময় পুকুরের মাছ বিক্রি করে নতুন করে চাষের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। হ্যাচারি থেকে রেনু উৎপাদন তারপর নার্সারিতে সেই রেণুকে পোনায় পরিনত করে চাষিদের কাছে বিক্রি করা হয়। তারপর সেই পোনা পুকুরে ছাড়ে চাষিরা।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে বিপাকে পড়েছেন রেণু, পোনা উৎপাদনকারী ও সাধারন চাষিরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, পরিবহন সঙ্কট, মাছ চাষের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ সহজলভ্য না থাকা, পোনা উৎপাদন কমে যাওয়া, মাছের ন্যায্য দাম না পাওয়া ও শ্রমিক সংকট বর্তমানে প্রধান সমস্যা।

ময়মনসিংহ সদরের রিলায়েন্স অ্যাকুয়া ফার্মের ম্যানেজার সঞ্জয় গোস্বামী জানান, তার নার্সারি থেকে কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাষিদের কাছে মনোসেক্স তেলাপিয়া, পাবদা, মাগুর, শিং মাছের পোনা সরবরাহ করা হয়। প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের পোনা তার নার্সারিতে এখন আটকে রয়েছে।
''চাষিরা পরিবহন সমস্যার কারণে পোনা নিতে পারছে না। পোনা বহনকারী পরিবহনকে রাস্তায় নানাবিদ সমস্যায় পড়তে হয়। তাই পোনা উৎপাদন বন্ধ রেখেছি।''
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম সানোয়ার রাসেল জানান, রমজানের আগে অনেক চাষির মাছ বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু পাইকারি বাজারে দাম কমে যাওয়ায় তারা মাছ পুকুরেই রেখে দিয়েছেন। এতে মাছের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এখন তাদের নতুন মাছ ছাড়ার কথা। এসব সমস্যার কারণে মাছ উৎপাদনের সাইকেল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
মৎস অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয় থকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত দুই মাসে মৎস সেক্টরে এক ময়মনসিংহ বিভাগেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্থ চাষীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
মৎস্য অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুুল মজিদ জানান, তারা মাঠ পর্যায়ে সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন। এখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, লকডাউন দির্ঘায়িত হলে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। জুন মাসের মধ্যে নতুন পোনা পুকুরে না ছাড়লে আগামী মৌসুমে উৎপাদন কমে যাবে।
তিনি বলেন, ''দেশে বদ্ধ জলাশয়ে উৎপাদন হয় প্রায় ২৪ লাখ টন মাছ।''
বাংলাদেশ ফিস হ্যাচারি ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির তরফদার বলেন, এপ্রিল-মে মাস পুকুরে পোনা ছাড়ার উৎকৃষ্ট সময়। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে চাষী বর্তমান বাজারজাতযোগ্য মাছগুলো বিক্রি করে নতুন মৌসুমের জন্য পুকুর প্রস্তুত করে ফেলেন। পোনা উৎপাদন, প্যাকেজিং, বিক্রয় ও পরিবহন নিয়ে যখন হ্যাচারীগুলোর ব্যস্ততম সময় পার করার কথা তখন বেচা-বিক্রি একরকম নেই বললেই চলে।
''বাজারে রেণুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সারা দেশ থেকে যারা এই রেণুগুলো সংগ্রহ করেন তারা লকডাউনের কারণে আসতে পারছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে হ্যাচারিগুলো স্থানীয় মাঝে কম দামে মাছের রেণু বিক্রি করছে। যদিও উৎপাদনের তুলনায় বিক্রি অনেক কম।'' অধিকাংশ হ্যাচারি তার উৎপাদন খরচ তুলতে পারবে কি না সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে খামারের অনেক কর্মচারী কাজে আসতে চাচ্ছেন না। এসব সমস্যার কারণে একদিকে যেমন মাছ চাষি, হ্যাচারি মালিকসহ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখিন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মৎস্য সেক্টর।
এদিকে, ভালো খবর হচ্ছে কৃষি খাতে মূলধন সরবরাহের উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করছে সরকার। যা কৃষির অন্যান্য সেক্টরের পাশাপাশি, করোনা সংকটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের প্রান্তিকসহ সকল খামারি, উৎপাদক, সরবরাহকারী এবং উদ্যোক্তাদের কম সুদে ঋণ গ্রহণের সুবিধার্থে প্রণয়ন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত চাষির হাতে এখনই সুবিধা পৌঁছানো না গেলে এই স্কিমে কাজের কাজ কিছুই হবে না। ব্যাহত হবে উৎপাদন, যার বড় প্রভাব পড়বে আগামী মৌসুমে।

বাংলাদেশ তেলাপিয়া ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম শামছুল আলম বলেন, সরকার যদি অর্থ দিতে চায় তাহলে জুন মাসের মধ্যেই তা চাষির হাতে পৌঁছাতে হবে। কারণ তখনই হাতে টাকার দরকার পড়বে। তা নাহলে চাষীরা চাষ শুরু করতে পারবে না। অনিশ্চয়তা দেখলে চাষি নতুন মৌসুমে মাছ চাষে নিরুৎসাহিত হবে। পাশাপাশি মংস্যখাতের এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সরকারের প্রণোদনার পাশাপাশি চলমান ব্যাংক ঋণের সুদ ও বিদ্যুত বিল মওকুফের দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক, গবেষক ড. হারুনুর রশীদ জানান, বিগত মৌসুমের মাছ বিক্রি করতে না পারা এবং নতুন মৌসুমে চাষ শুরু করতে না পারার ক্ষতি সুদুরপ্রসারী হতে পারে। পর পর দুটি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে চাষীরা যে ব্যাপক মূলধন ঘাটতিতে পড়বেন তাতে করে পরের বছর মাছ চাষ করা অনেক চাষীর পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে পরের বছরও মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক ঘাটতির কারণে দেশে প্রাণীজ আমিষের সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, দেশের প্রাণীজ আমিষের চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ যোগান দেয় মৎস্য সম্পদ। পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে যদি মৎস্য খাতের প্রকৃত উদ্যোক্তারা দ্রুত অর্থায়ন পান তাহলে সঙ্কট উত্তরণে সহায়ক হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে পুনঃঅর্থায়নের এই স্কিমই একমাত্র সমাধান নয়।