পুতিনের নতুন বাজির চাল অপেক্ষা করছে সাগরতলে

'একবার ঘটলে সেটা ঘটনা। দুবার ঘটলে কাকতালীয়। কিন্তু তিনবার একই জিনিস ঘটলে সেটা দুশমনের কাজ'—বলেছিলেন জেমস বন্ড স্রষ্টা। অতি সম্প্রতি তিন বিস্ফোরণে বাল্টিক সাগরের তলদেশে নর্ড স্ট্রিম গ্যাসের দুই পাইপলাইন লিক হওয়া নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যখন চিন্তিত, তখন ইয়ান ফ্লেমিংয়ের এই প্রবাদ তাদের সন্দেহ নিরসনে অনেকাংশেই সাহায্য করবে বলেই ধারণা।
ইউক্রেনের ওপর পুতিনের আক্রমণের সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো তিনি এই বিষয়ে ভ্যালেরি গেরাসিমভের (এখন রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান) সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেননি। অথচ ২০১৩ সালে এই লোকটির নির্দেশে রাশিয়ার সামরিক ব্যবস্থাপনা আমূলে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।
গেরাসিমভের মূল ধারণাটি হলো বর্তমান নেটওয়ার্ক যুগে যুদ্ধের ঐতিহাসিক উপাদানগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, তথ্যভিত্তিক, মানবিক এবং অন্যান্য বেসামরিক কর্মকাণ্ড সমন্বয় করা উচিত। এর মানে হলো গুলি চালানোর আগে সামাজিক গণমাধ্যম এবং অন্যান্য নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন ভুল, বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে, বিভাজনের সৃষ্টি করে নিরাশার দিকে ঠেলে দিতে হবে। এভাবে এগুতে থাকলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গণতান্ত্রিক শাসনগুলোর জন্য নাগরিকদের সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে।
ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের আক্রমণ অবশ্য এই ধারণার পুরোপুরি বিপরীত ছিল। এর কারণ সম্ভবত এই যে গেরাসিমভ পুতিনের অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনায় অংশ নেওয়া বিশ্বাসভাজনদের মধ্যে ছিলেন না, যাদের ওপর পুতিন প্রাথমিকভাবে নির্ভর করছিল। বরং পুতিনের আক্রমণটি ছিল ১৯৪০-এর দশকের ব্লিটজক্রিগ ধাঁচের ঝটিকা অভিযান। স্রেফ কালো এবং সাদার পরিবর্তে রঙিন!
কিন্তু সেটা কাজ করল না। আর তাই তাকে আবার নকশা বদলাতে হলো। ধারণা করা হয় পুতিন শেষ পর্যন্ত গেরাসিমভের দ্বারস্থ হন। সত্যিই এটা ঘটলে অসম যুদ্ধ এবং পশ্চিমা প্রতিপক্ষের সমালোচনাত্মক দুর্বলতা চিহ্নিত করার মতো বিষয়গুলোই তাদের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।
এর মানে হলো তারা পাইপলাইন সম্পর্কে কম, বরং সমুদ্রের তলদেশের ফাইবার-অপ্টিক তারগুলো নিয়েই তারা বেশি চিন্তা করছে। এই ফাইবার অপ্টিক তারগুলো আমাদের নেটওয়ার্ক জগতের স্নায়ুতন্ত্র। বর্তমানে প্রায় ৪৭৫টি ক্যাবল রয়েছে এবং তারা বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের সমস্ত ডেটা ট্র্যাফিকের ৯৫ শতাংশেরও বেশি বহন করে থাকে। এর মধ্য দিয়ে দৈনিক কমপক্ষে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ১৫০ লাখ আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। টেলিজিওগ্রাফি সাইটটি সব লেনদেনের একটি দুর্দান্ত আপ-টু-ডেট মানচিত্র রাখে।
মজার বিষয় হলো, আমরা ক্যাজুয়ালি আমাদের ডেটাগুলো 'ক্লাউডে' রাখার কথা বলি, যেন আমাদের মাথার ওপর কোনো অদৃশ্য মেঘে গিয়ে সেসব জমা থাকে। কিন্তু বাস্তবে ইন্টারনেট জগতের বেশিরভাগটাই পানির নিচে। আপনি যখন আপনার স্মার্টফোন থেকে 'ক্লাউড'-এ কোনো ছবি আপলোড করেন তখন এটি প্রথমে টেরা ফার্মার কোনো এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শেডে যেতে পারে, কিন্তু এরপর তা সমুদ্রতলের তারের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে গিয়ে ব্যাক আপ হিসেবে থাকে।
পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এই ক্যাবলগুলোকে ঘিরেই নির্মিত। দূরবর্তী সমুদ্র উপকূলবর্তী সীমান্তে অনেকক্ষেত্রেই দুর্বলভাবে সুরক্ষিত প্রবেশ পয়েন্টের মধ্যদিয়ে ক্যাবলগুলো সমুদ্র তলদেশে ঢুকেছে। প্রথম কয়েক মাইল পর্যন্ত জোয়ার, পাথর এবং অগভীর জলের ধাক্কা থেকে ক্যাবলগুলো রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক আবরণ থাকলেও সমুদ্রে যাওয়ার পর ক্যাবলগুলোর পুরুত্ব অনেকসময় বাগানের পানির পাইপের সমানও হয়ে থাকে।
ক্যাবলগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন বেসরকার সংস্থার মালিকানাধীন। আর তাই এখন পর্যন্ত অন্তত কোনো সরকার এসব ক্যাবল নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। ফেসবুকের মতো বিভিন্ন টেক জায়ান্টদের মালিকানাধীন অনেক ক্যাবলও রয়েছে। যেমন নির্মাণাধীন সবচেয়ে দীর্ঘতম ক্যাবল টুআফ্রিকার মালিক এবং ইনস্টলার ফেসবুক। ৪৫ হাজার কিলোমিটার ক্যাবলটি আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়াকে সরাসরি সংযুক্ত করবে৷
একবার তারগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলে গেলে সামুদ্রিক আইন অনুযায়ী সেগুলো রক্ষায় তেমন বেশি নীতিমালাও নেই। এই আইনগুলো সেই মান্ধাতার আমলে তৈরি যখন কিনা কেন্দ্রীয় ক্যাবলের অস্তিত্বই ছিল না। আর তাই মাঝ সমুদ্রে সেগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণাধীন দেশগুলোর নৌবাহিনীরও ক্যাবল রক্ষায় বেশি কিছু করার নেই।
সমুদ্রের তলায় পড়ে থাকা তারগুলো তাই স্পষ্টভাবেই যেকোনো দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দাবি মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারের কারণে বছরে প্রায় ১০০ বার ক্যাবল বিচ্যুতি ঘটে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবশ্য ফাইবার অপটিক ক্যাবল আক্রমণ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা ছিল না। সে বছর ইউকে থেকে ইউএস এবং ফ্রান্স থেকে ইউএসগামী দুটি ট্রান্সআটলান্টিক ক্যাবলে এরকম দুটো ঘটনা ঘটলেও সেগুলো খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। কিন্তু সেখান থেকেই সম্ভবত পলিসি এক্সচেঞ্জ থিংক ট্যাঙ্কের হয়ে ঋষি সুনাক সমুদ্রের তলদেশের ক্যাবল নেটওয়ার্কগুলোর ঝুঁকি নিয়ে একটি পেপার প্রকাশ করেন। তিনি সেখানে নেটওয়ার্কগুলোর দুর্বল অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং একে 'অস্তিত্ব সংকট'-এর সমতুল্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্তন ন্যাটো সুপ্রিম মিত্র কমান্ডার অ্যাডমিরাল জেমস স্টাভরিডিস উল্লেখ করেন, 'রাশিয়ান সাবমেরিন বাহিনী উত্তর আটলান্টিকের গভীর সমুদ্র তলদেশের ক্যাবল অবকাঠামোর চারপাশ বিশদভাবে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে'। দুটি কারণে এটা বেশ মজার। একটি হলো বর্তমানে ক্রেমলিনে চলমান আলোচনা। দ্বিতীয়টি হলো স্বয়ং স্টাভরিডিস। স্টাভরিডিস দারুণ এক থ্রিলারের সহ-লেখক। '২০৩৪: আ নোভেল অব দ্য নেক্সট ওয়ার্ল্ড ওয়্যার' থ্রিলার বইটিতে দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে একটি রাশিয়ান জাহাজ সমুদ্র তলদেশের ৩০টি ক্যাবল বিচ্ছিন্ন করে। এরফলে সারাবিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুতিন এই থ্রিলার বই পড়েছেন কি না, তা নিয়ে অবশ্য আমার সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু আমি বাজি ধরতে পারি জেনারেল গেরাসিমভ বইটি পড়েছেন।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তরিত