প্যারিসের ৪৭৫ বছরের পুরোনো বইয়ের বাজার; যেভাবে টিকে আছে ডিজিটাল যুগেও
কাজের সময় নিজের মর্জিমাফিক। মাথার ওপর নেই বসের খবরদারি। বরং আছে অফুরান খোলা বাতাস আর চোখের সামনে ঐতিহাসিক নটর ডেম ক্যাথেড্রালের মুগ্ধ করা দৃশ্য। এমন চাকরির মজাই যে আলাদা! প্রায় ৫০০ বছর ধরে প্যারিসের 'বুকিনিস্ট'রা সেইন নদীর তীরে এভাবেই তাদের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। শত বাধা-বিপত্তিতেও তারা তাদের এই ঐতিহ্যবাহী পেশা টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।
৭৬ বছর বয়সী সিলভিয়া ব্রুই বলেন, 'এটা কি শুধুই একটা চাকরি? মোটেও না, এটা আমার জীবন।' তিনি আট বছর ধরে কুয়াই ডি কন্তি এলাকায় পুরোনো বই বিক্রি করছেন। তিনি আরও বলেন, 'আমরা এমন জিনিস বিক্রি করি, যা আমরা নিজেরাও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।'
প্যারিসের এই বিশ্বখ্যাত বই বিক্রেতাদের ইতিহাসের শুরু সেই ১৫৫০ সালে। তখন ফরাসি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র 'ইল দে লা সিতে' এলাকায় ডজনখানেক হকার দোকান সাজিয়ে বসতেন। তবে ১৬০৬ সালে 'পঁ নফ' সেতু নির্মাণের পর এই ব্যবসা জমে ওঠে। এটিই ছিল প্যারিসের প্রথম সেতু, যার ওপর কোনো ভবন বা দালান ছিল না। ফলে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা সেখানে নতুন করে পসরা সাজিয়ে বসার জন্য এক বিশাল ফাঁকা জায়গা পেয়ে যান।
১৯০০ সালের শুরুর দিকে শহর কর্তৃপক্ষ দোকানগুলোর রূপ বা নকশা নির্দিষ্ট করে দেয়। বিক্রেতারা 'ওয়াগন গ্রিন' বা ট্রেনের বগির মতো বিশেষ সবুজ রঙের ধাতব বাক্সে বই বিক্রি শুরু করেন। নদীর দৃশ্য যাতে আড়াল না হয়, সে জন্য বাক্সের ঢাকনা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে সেইন নদীর দুই পাড় ঘেঁষে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ২৩০ জন বই বিক্রেতা বসেন। সেখানে প্রাচীন ও সমসাময়িক বই, খোদাই করা শিল্পকর্ম, ডাকটিকিট এবং ম্যাগাজিন পাওয়া যায়।
পাথরের তৈরি ঐতিহাসিক ভবনগুলোর সামনে খোলা আকাশের নিচে এই বইয়ের দোকান—বইপ্রেমীদের জন্য এর চেয়ে চমৎকার পরিবেশ আর কী হতে পারে!
বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা
এই বই বিক্রেতাদের কোনো কর বা ভাড়ার ঝামেলা পোহাতে হয় না। তবে তাদের কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। প্যারিস কর্তৃপক্ষই খালি জায়গাগুলো বরাদ্দ দেয়। এর তদারকির জন্য একটি বিশেষ কমিটিও আছে। কেউ দোকান দিতে চাইলে তাকে জীবনবৃত্তান্ত বা সিভির সঙ্গে একটি চিঠিও জমা দিতে হয়, যেখানে ব্যাখ্যা করতে হয় কেন তারা এই পেশায় আসতে চান।
'অ্যাসোসিয়েশন কালচারেল দে বুকিনিস্ট দে প্যারিস'-এর সভাপতি জেরোম ক্যালে সিএনএনকে বলেন, 'আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে বইয়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা বা প্রতিশ্রুতি আছে।' ২০২৫ সালের অক্টোবরে ১২ জন নতুন বই বিক্রেতা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিটি অনুমতির মেয়াদ থাকে পাঁচ বছর। আবহাওয়া খারাপ না থাকলে সপ্তাহে অন্তত চার দিন দোকান খোলা রাখতেই হয়। তারা পুরোনো বই, সেকেন্ড হ্যান্ড বই, পুরোনো কাগজপত্র এবং খোদাই করা শিল্পকর্ম বিক্রি করতে পারেন। এর সঙ্গে মুদ্রা, মেডেল, পুরোনো ডাকটিকিট ও পোস্টকার্ডের মতো ছোটখাটো জিনিসও রাখা যায়। তবে শর্ত হলো, এসব জিনিস একটি বাক্সের বেশি জায়গায় রাখা যাবে না।
জেরোম ক্যালে বলেন, 'এই কাজের জন্য আপনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকা দরকার।' তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে বিক্রেতাদের বেশির ভাগের বয়স ৫০-এর কোঠায় বা তার বেশি। এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ বিক্রেতাই এই বয়সী।
নতুন বুকিনিস্ট ওজান ইগিটকেস্কিন এই প্রবীণ দলেরই একজন সদস্য। তিনি বহুভাষিক বই রাখার পরিকল্পনা করেছেন। ৫২ বছর বয়সী ওজান আগে অনলাইনে বই বিক্রি করতেন। এরপর তিনি নদীর তীরে দোকান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, '১৫ বছর বয়সে ইস্তাম্বুলে সাইকেলে করে বই বিক্রি দিয়ে আমার কাজ শুরু। জীবনে টাইপিস্ট ও সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছি। কিন্তু বইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসা আজও অটুট।'
ওজান ভালো করেই জানেন ছোট বইয়ের দোকান চালানো কতটা কঠিন, বিশেষ করে মাস শেষে ভাড়া মেটানো। তবে বুকিনিস্ট হিসেবে অন্তত ভাড়ার সেই চিন্তায় তাকে পড়তে হবে না।
ছয় বছর আগে ৩৫ বছর বয়সী ক্যামিল গুডো নিজের দোকান চালু করেন। তিনি 'কুয়াই ডি ল'হোটেল ডি ভিলে' এলাকায় সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি বই বিক্রি করেন। এর আগে তিনি অন্য বিক্রেতাদের হয়ে কাজ করতেন।
সিএনএনকে তিনি বলেন, 'আমি কম দামে পুরোনো বই বিক্রি করি। আমার উদ্দেশ্য হলো—যারা বই পড়ে না, খুব কম পড়ে বা পড়া ছেড়ে দিয়েছে, তাদের আবার বইয়ের জগতে ফিরিয়ে আনা।'
সিলভিয়া ব্রুই পাশ থেকে যোগ করেন, 'আমার কাছে ৩০ বছর বয়সী এক নারী এসেছিলেন। তিনি বইয়ের দোকানে ঢুকতেই সাহস পেতেন না। অথচ তিনি এখান থেকে তার জীবনের প্রথম বই 'দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি' কিনেছিলেন। পরে তিনি জেমস জয়েসের বইও পড়েছেন। এখন তিনি নিয়মিত বইয়ের দোকানে যান।'
আইপিএসওএস/সিএনএলের জরিপ বলছে, গত এক দশকে ফরাসি পাঠকরা নতুনের চেয়ে পুরোনো বই বেশি কিনছেন। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীরা বছরে গড়ে সবচেয়ে বেশি বই পড়ছেন।
স্বাধীনতা ও মানুষের সঙ্গ
বই বিক্রেতারা সারা বছর রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাইরে কাজ করেন। সম্বল বলতে কেবল একটি ফোল্ডিং চেয়ার আর ছোট্ট টেবিল। এই টেবিলটিই একাধারে ডেস্ক ও কাউন্টার হিসেবে কাজ করে। দোকানের আরাম-আয়েশ ছেড়ে কেন তারা এই জীবন বেছে নেন?
বুকিনিস্ট ক্যামিল গুডো সিএনএনকে ব্যাখ্যা করেন, 'আমি ঘরের চার দেয়ালের ভেতর আটকে থাকতে পছন্দ করি না। অন্যের অধীনে কাজ করা আমার জন্য কঠিন। বই বিক্রেতা হিসেবে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিজের রাজা।'
গুডো আরও বলেন, 'এটি মানুষের সঙ্গে মেশার খুব সহজ উপায়।' কিছু মানুষের কাছে এই দোকানগুলো আশ্রয়ের মতো। অনেকের কাছে দিনের একমাত্র হাঁটার সুযোগ বা একমাত্র কথা বলার জায়গা এটাই।
১৫ বছর ধরে বই বিক্রি করছেন ক্লেয়ার লেরিচে। তিনি বলেন, মানুষের সঙ্গে এই সরাসরি যোগাযোগই আসল পার্থক্য গড়ে দেয়। তিনি বলেন, 'মানুষ যখন তিনটি পোস্টকার্ড কেনে, আমি তাদের স্ট্যাম্পটি দেখাই। তাদের বলি—দেখুন, এটি ১৯০৪ সালে পাঠানো হয়েছিল। এতে তারা খুশি হয়, কারণ এর সঙ্গে একটি ছোট গল্প জড়িয়ে থাকে।'
২৬ বছর বয়সী সাহিত্যের শিক্ষার্থী লরা কনট্রেসাস প্রায়ই এখানে আসেন। তিনি বিখ্যাত ফরাসি লেখিকা সিমোন দ্য বোভোয়ারের চিঠিপত্র নিয়ে গবেষণা করছেন। মূলত দর্শন ও প্রবন্ধের বই কেনেন তিনি। তিনি বলেন, 'এর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এখানকার প্রতিটি জিনিসের নিজস্ব গল্প আছে।'
২৩ বছর বয়সী মেরি-স্যামুয়েল ক্লেইনও নিয়মিত আসেন। তিনি বলেন, 'আমি এই জায়গাটা পছন্দ করি কারণ এখানে খুঁজলে সব সময় রত্ন পাওয়া যায়। আমি পুরোনো বই আর এর সোঁদা গন্ধ পছন্দ করি। এর মধ্যে প্রতীকী কিছু ব্যাপার আছে। এটা ভাবতেই ভালো লাগে যে আমার আগে অনেক মানুষ এই বইটি হাতে নিয়ে পড়েছে।'
নতুনের ভিড়ে পুরোনো
ই-বুক বা অনলাইন বই বিক্রেতাদের এই ডিজিটাল যুগেও প্যারিসের বুকিনিস্টরা টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর।
জেরোম ক্যালে বলেন, 'মানুষকে এখানে টেনে আনা আমাদের ওপরই নির্ভর করে। এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের চোখের ভাষায় যোগাযোগ হয়। আমরা যান্ত্রিক শহরে মানবতা ও সংস্কৃতির এক মরূদ্যান গড়ে তুলেছি।'
সম্প্রতি এক অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে তাদের অস্তিত্বের ওপর হুমকি এসেছিল। সেটি হলো ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক। সেইন নদীর তীরে অলিম্পিকের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে নিরাপত্তার স্বার্থে বুকিনিস্টদের উচ্ছেদ করার কথা উঠেছিল। কিন্তু তারা এর বিরুদ্ধে লড়েছেন। জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তারা প্যারিসের কেন্দ্রে নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছেন।
সেইন নদীর তীর থেকে ক্যামিল গুডো বলেন, প্রতিবছরই মানুষ বলে, 'হায় ঈশ্বর, কী ভয়ংকর অবস্থা! বই বিক্রেতারা হারিয়ে যাচ্ছে।' কিন্তু বাস্তবে দেখুন, আমরা এখনো আছি। আশা করি, আমরা আরও অনেক দিন এভাবেই থাকব।'
