এপস্টিন মামলা সম্পর্কিত আরও ১০ লাখ নথির সন্ধান পেল মার্কিন কর্তৃপক্ষ
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মার্কিন কর্তৃপক্ষ প্রয়াত শিশু যৌন নিপীড়ক জেফ্রি এপস্টিনের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে এমন আরও ১০ লাখেরও বেশি নথিপত্র খুঁজে পেয়েছে।এসব নথি আগামী কয়েক দিন ও সপ্তাহের মধ্যে ধাপে ধাপে প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। খবর বিবিসির।
নিউইয়র্কের ফেডারেল প্রসিকিউটররা ও এফবিআই এই নথিগুলো উদ্ধারের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে (ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস) অবহিত করেছে।
গত বুধবার বিচার বিভাগ (ডিওজে) জানিয়েছে, 'ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার জন্য আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন রাখতে (রিড্যাকশন) আমাদের আইনজীবীরা দিন-রাত কাজ করছেন। যত দ্রুত সম্ভব আমরা নথিগুলো প্রকাশ করব।'
বিভাগটি আরও জানিয়েছে, সব নথি প্রকাশে 'আরও কয়েক সপ্তাহ' সময় লাগতে পারে। একটি নতুন আইনের অধীনে গত ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে এপস্টাইন সংক্রান্ত সব নথি প্রকাশের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। সেই সময়সীমা অনুযায়ী নথিগুলো প্রকাশ না করায় বিচার বিভাগ বর্তমানে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা 'ফেডারেল আইন এবং নথিগুলো প্রকাশের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশনা পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলা অব্যাহত রাখবে।'
তবে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়নি, এফবিআই এবং নিউইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের মার্কিন অ্যাটর্নি কীভাবে এই অতিরিক্ত নথিগুলোর সন্ধান পেয়েছে। নিউইয়র্কের একটি কারাগারে বিচার শুরুর অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় এপস্টিনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
বিচার বিভাগ এপস্টিন সংক্রান্ত তাদের তদন্তের সঙ্গে যুক্ত হাজারো নথি প্রকাশ করে, যার অনেকগুলোতেই ব্যাপকভাবে তথ্য গোপন রাখা হয়েছে (রিড্যাক্টেড)।
বিভাগটি পর্যায়ক্রমে এই নথিপত্রগুলো প্রকাশ করছে এবং শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, এখনো কয়েক লাখ নথি প্রকাশ করা বাকি রয়েছে।
'এপস্টিন ফাইল ট্রান্সপারেন্সি অ্যাক্ট' পাস হওয়ার পর এসব নথি প্রকাশ করা হয়। আইনটি মার্কিন কংগ্রেস পাস করে এবং এতে স্বাক্ষর করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আইনে ভুক্তভোগীদের পরিচয় সুরক্ষিত রেখে এপস্টিন–সংক্রান্ত সব নথি জনসমক্ষে প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত নথিপত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিডিও, ছবি, ইমেল এবং তদন্তের বিভিন্ন নথি। তবে এগুলোর অনেক জায়গায় ব্যাপকভাবে তথ্য গোপন বা মুছে ফেলা (রিড্যাকশন) হয়েছে। এর মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তির নামও রয়েছে যাদেরকে এফবিআই এপস্টিন মামলায় সম্ভাব্য সহযোগী বা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উল্লেখ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নথিপত্রে তথ্যের অতিমাত্রায় কাটছাঁট বা গোপনীয়তা (রিড্যাকশন) রক্ষা করার কারণে বিচার বিভাগ উভয় রাজনৈতিক দলের আইনপ্রণেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র ভুক্তভোগীদের পরিচয় এবং চলমান কোনো অপরাধের তদন্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই তথ্য গোপন রাখার অনুমতি রয়েছে।
অতিরিক্ত নথিপত্র খুঁজে পাওয়ার খবর ঘোষণার পর, এপস্টিনকাণ্ডের তদন্তকারী সংসদীয় প্যানেল 'হাউস ওভারসাইট কমিটি'-র শীর্ষ ডেমোক্র্যাট সদস্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি হোয়াইট হাউসের বিরুদ্ধে 'অবৈধভাবে' এই নথিগুলো আটকে রাখার অভিযোগ তোলেন।
এক বিবৃতিতে প্রতিনিধি রবার্ট গার্সিয়া বলেন, 'প্রতিদিনই আমরা মিথ্যাচার, অদক্ষতা, সময়সীমা না মানা এবং অবৈধ রিড্যাকশন দেখতে পাচ্ছি।'
কংগ্রেসে পাস হওয়া এবং গত মাসে ট্রাম্পের স্বাক্ষর করা আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে—লজ্জাজনক হতে পারে বা "সম্মানহানি" করতে পারে, এমন কোনো নাম বা তথ্য গোপন রাখার অনুমতি দেওয়া হবে না।
আইনটিতে বিশেষভাবে বিচার বিভাগের কাছে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও স্মারক (মেমো) চাওয়া হয়েছে, যেখানে কারা তদন্তের আওতায় এসেছিলেন এবং এপস্টিন বা তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে 'মামলা করা হবে কি না, তদন্ত করা হবে কি না, বা তদন্ত থেকে বিরত থাকা হবে কি না'—এসব সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয়েছে, তার বিস্তারিত থাকতে হবে।
নথিগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে এফবিআই কর্মীদের মধ্যে আদান-প্রদান করা এমন কিছু ইমেল রয়েছে। এসব ই–মেইলে এপস্টিনের ১০ জন সম্ভাব্য "সহ-ষড়যন্ত্রকারীর" কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ই–মেইলগুলোতে বলা হয়, এই দলের ছয়জনকে আদালতে সমন ('সাবপিনা') করা হয়েছিল। এদের মধ্যে তিনজন ফ্লোরিডায়, একজন বোস্টনে, একজন নিউ ইয়র্ক সিটিতে এবং একজন কানেকটিকাটে ছিলেন।
এপস্টিনের অপরাধে সম্ভাব্য সহষড়যন্ত্রকারীদের শনাক্ত করা তার ভুক্তভোগীদের জন্য একটি বড় বিষয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের কাছে আরও স্বচ্ছতা দাবি করা কয়েকজন আইনপ্রণেতার কাছেও এটি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
এপস্টাইন সংক্রান্ত নথিপত্রের আগের প্রকাশনাগুলো থেকে এমন সব তথ্য বেরিয়ে এসেছিল যা আটলান্টিকের দুই পারেই (আমেরিকা ও ইউরোপে) ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
সাজাপ্রাপ্ত শিশু যৌন অপরাধী জেফরি এপস্টাইনের সাথে বন্ধুত্বের বিস্তারিত তথ্য সামনে আসার পর পিটার ম্যান্ডেলসনকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নথিতে দেখা গেছে যে, ২০০৮ সালের জুনে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে দিয়ে যৌনবৃত্তি করানোর অভিযোগে এপস্টিনের সাজা শুরু হওয়ার আগের দিন ম্যান্ডেলসন তাকে বলেছিলেন, 'আমি তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা করি।'
লর্ড ম্যান্ডেলসন কর্মীদের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে তার বিদায়ের পরিস্থিতির জন্য তিনি 'গভীরভাবে অনুতপ্ত'। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছিল তার 'জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বা গৌরব'। এপস্টিনের সাথে ২০ বছর আগের মেলামেশা এবং তার ভুক্তভোগীদের দুর্দশার কথা ভেবে তিনি 'অত্যন্ত লজ্জিত ও বিষণ্ণ' বোধ করছেন বলেও উল্লেখ করেন।
এপস্টিনের সঙ্গে মেলামেশার কারণে দীর্ঘকাল ধরে চলা নিবিড় তদন্ত ও সমালোচনার জেরে গত অক্টোবরে অ্যান্ড্রু মাউন্টব্যাটেন-উইন্ডসর তার 'রাজপুত্র' উপাধি হারান এবং তাকে তার উইন্ডসর বাসভবন 'রয়্যাল লজ' ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সর্বশেষ নথিপত্রে ২০০১ সালের একটি ই–মেইলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 'বালমোরাল' থেকে 'এ' নামে চিহ্নিত একজন ব্যক্তি এপস্টিনের সহযোগী ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী গিসলেন ম্যাক্সওয়েলকে ই–মেইলটি পাঠান। ম্যাক্সওয়েলকে ২০২২ সালে অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই ই–মেইলে লেখা ছিল, 'তুমি কি আমার জন্য নতুন কিছু অনুপযুক্ত বন্ধু খুঁজে পেয়েছ?'
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার জন্য বিবিসি অ্যান্ড্রুর টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তিনি বারবার কোনো ধরণের অপরাধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, তিনি এমন কোনো আচরণ 'দেখেননি বা সন্দেহ করেননি যা পরবর্তীতে এপস্টিনের গ্রেপ্তার ও সাজা পাওয়ার কারণ হতে পারে।'
