শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে ইরাক, বিতর্কিত ‘তেলের বিনিময়ে পানি’ চুক্তিতেই ভরসা এখন
দজলা আর ফোরাত—নাম দুটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ছবি। হাজার বছর ধরে সভ্যতা গড়ে ওঠার সাক্ষী এই দুই নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে জনবসতি। তুরস্কের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে পাশাপাশি বয়ে চলা এই দুই জলধারা ইরাকের প্রাণভোমরা। কিন্তু ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী এই দজলা-ফোরাত আজ মৃতপ্রায়।
উজানে দেওয়া বাঁধ আর ভয়াবহ খরায় গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র পানির সংকটে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। এখন পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়ে নিজেদের সবচেয়ে দামি সম্পদ 'তেল'–কে কাজে লাগাচ্ছে ইরাক।
৪ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষের দেশটিতে পানি সরবরাহ কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তুরস্ক, ইরান ও সিরিয়ায় নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ অন্যতম। এ ছাড়া কয়েক দশকের যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা আর অস্থিতিশীলতার কারণে ইরাকের পানি অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি অব্যবস্থাপনা।
এর ওপর আবার 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার মুখে পড়েছে ইরাক।
চলতি মাসে ইরাকে কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও বন্যায় অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা। গত সোমবার এক বিবৃতিতে দেশটির পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, টানা কয়েক বছরের অনাবৃষ্টির কারণে ইরাকের বাঁধগুলোতে এখনো পানির বিশাল ঘাটতি রয়ে গেছে।
একদিকে পানি কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে চাহিদা। শহরে জনসংখ্যা বাড়ছে। আবার দেশটির মোট পানির ৮০ শতাংশই খরচ হয় কৃষিকাজে, ফলে কৃষিখাতটিও এখন হুমকির মুখে।
তুরস্কের সঙ্গে 'তেলের বিনিময়ে পানি' চুক্তি
ইরাকের পানির উৎসের প্রায় ৬০ শতাংশই আসে প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক থেকে। তবে উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে আগের চেয়ে অনেক কম পানি পাচ্ছে দেশটি। এই সংকট কাটাতে এবার তুরস্কের সঙ্গে বিতর্কিত একটি সহযোগিতা চুক্তিতে গেছে বাগদাদ। সহজ কথায়, এই চুক্তির মূল বিষয় হলো—ইরাকের তেল আয়ের বিনিময়ে দেশটির পানি অবকাঠামো উন্নয়ন করে দেবে তুরস্ক।
ইরাকি গ্রিন ক্লাইমেট অর্গানাইজেশনের প্রধান ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মুখতার খামিস বলেন, তুরস্ক দজলা ও ফোরাত নদীর উজানে যেসব বাঁধ দিয়েছে, তা ইরাকে পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিচ্ছে। এতে ইরাকের চলমান পানি সংকট আরও গভীর হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরের পর বছর ধরে চলা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে পানি বণ্টন নিয়ে দরকষাকষিতে ইরাক বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। সংকট যখন চরমে, তখনই তুরস্কের সঙ্গে এই সহযোগিতা চুক্তি করল বাগদাদ।
গত নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে কয়েক শ কোটি ডলারের 'ওয়াটার কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট' চূড়ান্ত হয়। এই চুক্তির আওতায় তুর্কি কোম্পানিগুলো ইরাকের পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করবে। বিষয়টি অনেকটা তেলের বিনিময়ে পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টার মতো।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর পানিবিষয়ক উপদেষ্টা তুরহান আল-মুফতি জানান, চুক্তি অনুযায়ী ইরাক প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল বিক্রি করবে। সেই অর্থ একটি তহবিলে জমা হবে, যা দিয়ে পানি অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ করা তুর্কি কোম্পানিগুলোকে দাম পরিশোধ করা হবে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পানি ধরে রাখার বাঁধ নির্মাণ ও ভূমি পুনরুদ্ধার।
আঙ্কারা অবশ্য বিষয়টিকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার অংশ হিসেবেই দেখছে। বাগদাদে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেন, 'তুরস্ক ইরাকের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে সহায়তা করতে আগ্রহী। এ বিষয়ে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।'
'মানবাধিকার' বনাম 'পণ্য'; বিতর্কে পানি চুক্তি
ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হোসেন অবশ্য এই চুক্তিকে দেশের পানি নিরাপত্তা, খাদ্য উৎপাদন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য বলে বর্ণনা করেছেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দজলা ও ফোরাত নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি না থাকায় বাগদাদ দীর্ঘদিন ধরে অসহায় অবস্থায় ছিল।
ইরাক সরকারের পানিবিষয়ক উপদেষ্টা আল-মুফতি বলেন, 'এই প্রথমবারের মতো দজলা ও ফোরাতের পানির স্থায়িত্ব নিয়ে একটি স্পষ্ট ও বাধ্যবাধকতামূলক ব্যবস্থা তৈরি হলো।' তিনি জানান, এই চুক্তির ফলে কৃষি, শিল্প ও মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী ইরাকে পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ বজায় রাখতে দুই পক্ষই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে এই চুক্তি নিয়ে ইরাকের রাজনীতিবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা ও অবিশ্বাসও রয়েছে। বাগদাদভিত্তিক পানি নীতি বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ শুরকি আলাবায়াচি বলেন, পানি মানুষের মানবাধিকার। একে তেলের আয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পণ্যে পরিণত করা উচিত নয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, তুরস্কের সঙ্গে এই চুক্তি আন্তর্জাতিক পানি কূটনীতির স্বীকৃত নীতির পরিপন্থী।
তার মতে, এটি ইরাকের পানি সংকটের কোনো সমাধান নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী, সার্বভৌম ও পেশাদার পানিনীতি এবং কৃষিখাতের সংস্কার।
সার্বভৌমত্ব হারানোর শঙ্কা
অনেকের আশঙ্কা, এই চুক্তির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ইরাকের দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ সহযোগী নাতাশা হল সতর্ক করে বলেন, দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থার ওপর অতি নির্ভরশীলতা ইরাকের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
নাতাশা হল বলেন, 'তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি সঠিক পথে একটি পদক্ষেপ হতে পারে, তবে সংকট মোকাবিলায় ইরাকের আরও বেশি কিছু প্রয়োজন।' তিনি আরও বলেন, অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে এর মাধ্যমে তুরস্ক তার দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশটির ওপর ভবিষ্যতে বড় ধরনের খবরদারি করার সুযোগ পাবে।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের তুরস্ক কর্মসূচীর পরিচালক গোনুল টোল মনে করেন, এই চুক্তি তুরস্কের পাল্লা ভারী করেছে। ইরাক যখন দুর্বল অবস্থানে, ঠিক তখনই দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর তুরস্কের প্রভাব বাড়ল।
অবশ্য ইরাকি কর্মকর্তারা এসব সমালোচনা মানতে নারাজ। আল-মুফতির দাবি, পানি ব্যবস্থাপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইরাকের হাতেই থাকবে।
এরদোয়ানের লাভ ও ট্রাম্পের চাপ
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই চুক্তিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের লাভই বেশি। গোনুল টোল বলেন, ২০২৮ সালের নির্বাচনের আগে দেশের ভেতরে নিজের অবস্থান শক্ত করতে এবং আঞ্চলিক কূটনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এরদোয়ান এই চুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যের সঙ্গেও এই চুক্তি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তাও এখানে বড় একটি বিষয়। গোনুল টোল উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে এরদোয়ানকে চাপ দিচ্ছেন। ইরাকি তেলের মান রাশিয়ার তেলের মতোই। ফলে এটি রাশিয়ার তেলের একটি স্বাভাবিক বিকল্প হতে পারে।
খরায় তছনছ জনজীবন, কৃষকের হাহাকার
সাধারণ ইরাকিদের কাছে পানি সংকট কোনো নীতি নির্ধারণী বিতর্ক বা কূটনৈতিক চাল নয়; এটি শুধুই বেঁচে থাকার লড়াই। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, খরাসহ জলবায়ু ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ইরাকি ফেডারেশন অব এগ্রিকালচারাল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পানির অভাবে হাজার হাজার কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছেন সাময়িক কাজ, কেউবা কৃষি ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
ইরাকের মধ্যাঞ্চলীয় বাবেল প্রদেশের সাবেক কৃষক আহমেদ আল-জাশামির গল্পটা হৃদয়বিদারক। পানির অভাবে চোখের সামনে নিজের ফলের বাগান শুকিয়ে যেতে দেখে কষ্টে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার বাবা। জাশামি বলেন, 'আমরা বংশপরম্পরায় কৃষক। ভাবতেও পারিনি, একদিন চোখের সামনে আমাদের সব খামার ও বাগান মরে যাবে।' জাশামি এখন আর কৃষি কাজ করেন না, ছোট একটি দোকানে নির্মাণসামগ্রী বিক্রি করেন।
একই করুণ দশা বাগদাদের পশ্চিমে ফালুজা শহরের উপকণ্ঠের বাসিন্দা হুসাম আনিজান-এর। পাঁচ একর জমিতে প্রতিবছর প্রচুর কমলা ফলত তার। কিন্তু পানির অভাবে সেচ দেওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়ে। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে দেন তিনি।
হুসাম বলেন, 'সেচ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জমি বিক্রি করার সময় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। চোখের সামনে আমার সেই কৃষি জমিতে এখন ঘরবাড়ি উঠেছে, যা দেখা খুবই কষ্টের।' হুসাম এখন জীবন চালাতে ট্যাক্সি চালান।
আহমেদ ও হুসাম—দুজনেই এই পরিস্থিতির জন্য সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিকে দায়ী করেন। তাদের মতো অসংখ্য কৃষক এমন জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন, যা তারা কখনোই চাননি।
তবে তুরস্কের সঙ্গে হওয়া 'তেলের বিনিময়ে পানি' চুক্তি নিয়ে কিছুটা আশাবাদী হুসাম। বুকভরা দীর্ঘশ্বাস আর সামান্য আশা নিয়ে তিনি বলেন, 'দেখা যাক চুক্তিটি কীভাবে কাজ করে। হয়তো আমরা আবার আশার আলো দেখতে পাব।'
