পুতিনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারত যে শীতল বার্তা দিল ওয়াশিংটনকে
ভারত এই সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে, তা ওয়াশিংটনে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছে। দৃশ্যমান বার্তাটি ছিল এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়: ইউরোপকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়ার মুহূর্তে—যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে ইউরোপ যদি সংঘাতে উস্কানি দেয় তবে মস্কো "প্রস্তুত"—নয়াদিল্লি সেই সময়ই পুতিনের সফরকে উদযাপন করল ভারতের "স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি" বা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের প্রমাণ হিসেবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে, রাশিয়া যখন পশ্চিমা নিরাপত্তা কাঠামোকে দুর্বল করছে—সেই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য বজায় রাখা কোনো কূটনৈতিক সাফল্য না-বরং এক ধরনের কৌশলগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে: যখন ভারত নিজের আচরণ ও প্রতীকে এ বার্তা দিচ্ছে যে পশ্চিমা অগ্রাধিকারগুলো তার কাছে গৌণ, সেই ভারত কি এখনো আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের "অপরিহার্য স্তম্ভ" হিসেবে বিবেচিত হতে পারে?
গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-নীতি মূলত বাস্তববাদী মনোভাব ও আশাবাদী প্রত্যাশার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। ওয়াশিংটন চাইত একটি উদীয়মান ভারত—অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, সামরিকভাবে সক্ষম এবং ভৌগোলিকভাবে এমন স্থানে অবস্থিত যা চীনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ককে 'ঐতিহাসিক' বা 'লিগ্যাসি' বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল, কারণ মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে সেসময় পশ্চিমারা বেশি লাভজনক বলে মনে করেছে। সেজন্য যথেষ্ট ছাড়ও দিয়ে এসেছে।
কিন্তু বৈশ্বিক বাস্তবতা এখন আমূল বদলে গেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ, ইউরোপের প্রতি তার আক্রমণাত্মক ভাষা, এবং চীনের সঙ্গে আরও জোরাল কৌশলগত সখ্য—এসব মিলিয়ে এমন এক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে ভারতের পুরনো ধাঁচের ভারসাম্য রক্ষার নীতি পশ্চিমা জোটের কাছে আর সহজে গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে রাষ্ট্রের আচরণ মূলত নিরাপত্তা ও টিকে থাকার যুক্তিতে পরিচালিত হয়; জোটকে মূল্যবোধের চেয়ে বেশি দেখা হয় হাতিয়ার হিসেবে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের মস্কো-সখ্যকে এই দৃষ্টিকোণেই দেখে। প্রশ্নটি হলো—ভারত স্বাধীন কূটনীতি চালাচ্ছে কি না তা নয়; বরং তার এই আচরণ পশ্চিমা সমষ্টিগত নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করছে নাকি দুর্বল করে দিচ্ছে? — প্রশ্ন এটাই।
ইউরোপকে খোলাখুলিভাবে হুমকি দিচ্ছেন এমন এক নেতাকে প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়ে ভারত কার্যত পশ্চিমা নিরাপত্তা অবস্থানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নড়বড়ে করছে। বাস্তববাদী পরিভাষায়, সংকট মুহূর্তে ভারত তখন এমন এক অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়—যার অবস্থান নিয়ে পশ্চিমা জোট নিশ্চিন্ত হতে পারে না।
এই যুক্তি অবধারিতভাবেই ক্ষমতার ভারসাম্য-রাজনীতির দিকে নিয়ে যায়। কোনো রাষ্ট্র যদি কোনো সংশোধনবাদী শক্তির (রাশিয়ার) বিরুদ্ধে সমষ্টিগত পদক্ষেপে নির্ভরযোগ্যভাবে পাশে না থাকে, তবে পশ্চিমাদের যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া হলো—হেজিং; অর্থাৎ অংশীদারের বিস্তৃতি, প্রভাবের পুনর্বণ্টন এবং আঞ্চলিক ফলাফলে একক কোনো রাষ্ট্রকে অযৌক্তিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না দেওয়া। যেমনটা ভারতকে এতদিন ধরে দেওয়া হয়েছে।
ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে, ভারতের এই বেছে-বেছে অবস্থান নেওয়া রাশিয়াকে নিবৃত্ত করতে বা ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তার স্থাপত্য রক্ষায় যথেষ্ট নয়। ফলে মার্কিনীদের বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গভীরতর সম্পৃক্ততা কিংবা পাকিস্তানের দিকে নতুন করে দৃষ্টি দেওয়া—এগুলো এখন আর কেবল সুবিধাবাদী পদক্ষেপ নয়; বরং কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয় পথ।
ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি এই উদ্বেগ আরও বাড়ায়। তিনি বৈদেশিক সম্পর্ককে দেখেন লেনদেনমূলক সম্পর্কের আতসকাঁচে, যার মোদ্দা কথা হলো অংশীদারদের 'পক্ষ নিতে' হবে। এখানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে তিনি অস্পষ্টতা হিসেবে দেখেন, যা প্রায়ই মূল নিরাপত্তা লক্ষ্য থেকে নীরব বিচ্যুতি ঘটায়।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের 'স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি' দাবিকে ওয়াশিংটন প্রজ্ঞাপূর্ণ কূটনীতি হিসেবে নয়, বরং এক ধরনের সতর্ক সংকেত হিসেবে পড়ছে—যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রত্যাশাগুলো পূরণ নাও হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পুতিনকে আতিথ্য দেওয়া কোনো ছোটখাটো ঘটনা নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ভর ধারণার ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ জানায়।
এখানে প্রতীকের গুরুত্ব বিশাল। রাশিয়ার প্রতি ভারতের স্থায়ী উষ্ণতা দেখায় যে নয়াদিল্লি নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ অনুসরণ করবে—যা অনেক সময় ইন্দো-প্যাসিফিকে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমষ্টিগত স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তাই আর কেবল সৌহার্দ্যের ওপর নির্ভর করতে পারে না; সংকটমুহূর্তে ভারতের অবস্থান কী হবে তা আচরণের মাধ্যমেই পরিমাপ করতে হবে, কথার ফুলঝুড়ির মাধ্যমে নয়।
এর প্রভাব দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে স্পষ্ট হতে পারে। যদি ওয়াশিংটন ভারতের আঞ্চলিক কেন্দ্রীয়তা কমিয়ে দেয়, তবে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালের মতো দেশগুলো কৌশলগত বিকল্প অংশীদার হিসেবে আরও গুরুত্ব পেতে পারে, বিশেষত বাণিজ্য, কূটনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে। পাকিস্তান, যাকে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করেছে, ইতোমধ্যে নতুন করে মনোযোগ পাচ্ছে—চীন এবং অনিশ্চিত ভারতের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে বহুমাত্রিক প্রভাব কেন্দ্র গড়ে তুলতে।
আফগানিস্তান, যা এখনও অস্থির, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্র আর শুধুমাত্র ভারতের ওপর নির্ভর করে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না।
এক কথায়, ভারতের এই আচরণ যুক্তরাষ্ট্র যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জোট গঠনের ওপর নির্ভর করেছিল, সেটিকেই ভেঙে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে, এবং তার মাধ্যমে একটি বিস্তৃত ও অনিশ্চিত আঞ্চলিক ব্যবস্থা সামনে আসছে।
তবে এই পুনর্বিন্যাসে যুক্তরাষ্ট্র–ভারত অংশীদারিত্বের অবসান ঘটছে না। ইন্দো-প্যাসিফিকের কাঠামোগত বাস্তবতা—চীনা সম্প্রসারণ প্রতিরোধ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক আন্তঃসংযোগ—এখনো উভয় দেশের জন্য বাধ্যতামূলক লক্ষ্য। কিন্তু সম্পর্কটি এখন ক্রমশ শর্তসাপেক্ষ হয়ে উঠবে; যা পরিমাপ করা হবে পারস্পরিক নির্ভরযোগ্যতা, প্রতিশ্রুতি এবং সমষ্টিগত নিরাপত্তা উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে। ভারতের হেজিং বা দ্বৈত কৌশল তার কৌশলগত গুরুত্বকে কমিয়ে দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমীকরণে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
ভারত যুক্তি দেয় যে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও বাস্তবসম্মত। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই যুক্তিগুলোর গুরুত্ব কমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র বাস্তববাদী কৌশল বিবেচনায় বাধ্য হচ্ছে—নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হেজিং, অংশীদারদের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং এমন একটি ইন্দো-প্যাসিফিক স্থাপত্য নিশ্চিত করতে, যা কোনো একক, অনির্ভরযোগ্য অংশীদারের ওপর নির্ভর করে না।
রাশিয়ার সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির মুহূর্তে পুতিনকে আতিথ্য দেওয়া বোঝায় যে ভারতের অবস্থান লেনদেননির্ভর, পরিস্থিতিনির্ভর। চীনের সঙ্গে যেকোনো উচ্চ ঝুঁকির মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র যার ওপর ভরসা করতে পারে না।
সুতরাং পুতিনের সফর একদিকে প্রতীকী, অন্যদিকে আস্থার মাপকাঠি। প্রতীকে এটি ভারতের আত্মবিশ্বাসী 'স্বায়ত্তশাসিত শক্তি' পরিচয়কে শক্তিশালী করে। কিন্তু বাস্তবে, পশ্চিমা মিত্রদের কাছে এটি প্রশ্ন তোলে—ভারত কতটা নির্ভরযোগ্য, কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং কতটা সমষ্টিগত নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে প্রস্তুত?
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তায়, প্রতিযোগিতায় এবং বিশ্বস্ত প্রতিশ্রুতির প্রয়োজনীয়তায়—পশ্চিমের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রেখে চলার জন্য কিছু মূল্য দিতে হয়। তাই কূটনৈতিক রণকৌশলে স্পষ্টতাই প্রভাব নির্ধারণ করে, বাগাড়ম্বর নয়।
ভারত এখনো ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনাই কেবল যথেষ্ট নয়। যদি দিল্লি রাশিয়ার সাথে সখ্যকে পশ্চিমা প্রত্যাশার ওপরে স্থান দিতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রও নিজেকে পুনর্গঠন করবে—দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করবে, আস্থার মানদণ্ড বদলাবে এবং ক্রমেই একটি অস্থির অংশীদারের ওপর নির্ভরতা কমাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত স্থাপত্য—এবং তার ভেতরে ভারতের ভূমিকা—এখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারত মনে করতে পারে যে সে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে, কিন্তু শক্তির ভারসাম্যের বাস্তবনীতি বলছে—এই সমদূরত্ব এখন ঝুঁকিপূর্ণ এবং হয়তো আর এড়ানো সম্ভব না।
লেখক: অ্যাডভোকেট মাজহার সিদ্দিক খান পাকিস্তানের লাহোর হাইকোর্টের একজন আইনজীবী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এই লেখাটি এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার মূল নিবন্ধ থেকে টিবিএসের পাঠকদের জন্য অনূদিত।
