ইসরায়েল থাকায় ইউরোভিশন বর্জন: সঙ্কট সামলে কি টিকে থাকতে পারবে এই সঙ্গীত প্রতিযোগিতা?
গত বৃহস্পতিবার ইউরোভিশন গানের প্রতিযোগিতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের অংশগ্রহণের কারণে চারটি দেশ নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরও অনেক দেশ সরে যেতে পারে।
যারা বয়কট করেছে তাদের মধ্যে আছে আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। আয়ারল্যান্ড সাতবার এবং নেদারল্যান্ডস পাঁচবার এই প্রতিযোগিতায় জিতেছে। এই তালিকায় আরও আছে স্পেন এবং স্লোভেনিয়া। স্পেন ছিল এই আয়োজনের অন্যতম বড় অর্থদাতা।
গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে উত্তেজনা অনেক দিন ধরেই ছিল। এবার ইউরোভিশন পরিবারের সেই ফাটল সবার সামনে চলে এসেছে। এ বছর জুরি ভোটের পর ইসরায়েল দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভোটে বা 'পাবলিক ভোটে' তারা শীর্ষে ছিল। এ নিয়ে ভোটিং ও প্রচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল বলছে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা তাদের জন্য 'বিজয়'। তাদের মতে, সমালোচকরা ঘৃণা ছড়াচ্ছে এবং তাদের চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছিল।
তর্ক হয়েছে, ভোটও হয়েছে
ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন (ইবিইউ)-এর বৃহস্পতিবারের বৈঠকে এই বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়। ইসরায়েলকে বাদ দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সরাসরি ভোট হয়নি। তবে প্রচার ও পাবলিক ভোটিংয়ের নতুন নিয়ম নিয়ে ভোট হয়। এতে ইবিইউ-এর ৬৫ শতাংশ সদস্য পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ১০ শতাংশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
অস্ট্রিয়ার পাবলিক ব্রডকাস্টার 'ওআরএফ'-এর মহাপরিচালক রোলান্ড ওয়েইসম্যান বলেন, "বেশ উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। আমরা তর্ক করেছি, অন্যদের যুক্তি শুনেছি এবং এরপর গোপন ভোট দিয়েছি। এটাই গণতন্ত্র।" আগামী বছর অস্ট্রিয়াতেই এই আসর বসার কথা।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নতুন নিয়ম পাস হওয়ায় ইসরায়েল প্রতিযোগিতায় থাকার সুযোগ পায়। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য দেশগুলো সরে দাঁড়ায়।
স্পেনের ব্রডকাস্টার 'আরটিভিই'-এর প্রেসিডেন্ট হোসে পাবলো লোপেজ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, "পরিস্থিতি এই পর্যায়ে আসা উচিত ছিল না।" তিনি আয়োজকদের ওপর আস্থা হারিয়েছেন। তার মতে, আয়োজকরা "রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে" প্রভাবিত হয়েছেন। ইসরায়েল অবশ্য ভোটিং বা ভোট প্রভাবিত করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আরও দেশ কি সরে যাবে?
বয়কটের তালিকায় আইসল্যান্ডও যুক্ত হতে পারে। তারা আগামী সপ্তাহে সিদ্ধান্ত জানাবে। শুক্রবার বেলজিয়াম ও সুইডেন জানিয়েছে তারা প্রতিযোগিতায় থাকছে। তবে ফিনল্যান্ড শর্ত দিয়েছে। তারা বলেছে, আরও অনেক দেশকে অংশ নিতে হবে এবং খরচ অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো যাবে না।
ইউরোভিশন বিশেষজ্ঞ ডিন ভুলেটিক বিবিসিকে বলেন, "আগামী কয়েক সপ্তাহ বেশ উত্তেজনার হবে। আমরা হয়তো আরও বয়কট দেখতে পাব।" দেশগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার শেষ সময় ১০ ডিসেম্বর।
বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন
ইবিইউ-এর প্রেস রিলিজে একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। অনেক দেশ ইসরায়েলের ব্রডকাস্টার 'কান'কে প্রতিযোগিতায় রাখতে চেয়েছিল। কারণ 'কান' ইসরায়েল সরকারের চেয়ে স্বাধীন। এই চ্যানেলটি প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে।
ওয়েইসম্যান বলেন, "পাবলিক ব্রডকাস্টাররা অংশ নেয়, দেশ নয়। এটি ইসরায়েল সরকার নয়, এটি পাবলিক ব্রডকাস্টার।"
ধারণা করা হয়, ইউরোভিশনে থাকার কারণেই এই চ্যানেলটি সরকারের চাপ বা বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। ইসরায়েলকে বাদ দিলে সেখানে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারত।
তহবিলের ওপর এই বয়কটের প্রভাব বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্পেন ছিল 'বিগ ফাইভ' বা বড় পাঁচ দাতা দেশের একটি। তারা প্রতি বছর বিপুল অর্থ দেয়। এখন অন্য দেশগুলোকে এই খরচ বহন করতে হবে। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যকে হয়তো সিংহভাগ খরচ দিতে হবে।
ইউরোভিশন গবেষক জেস কার্লিন বলেন, "বড় দাতাদের হারানো বিশাল ব্যাপার। এর ফলে ছোট দেশগুলোর ওপর চাপ পড়বে। আগামী বছর হয়তো আমাদের ছোট পরিসরে এই আয়োজন দেখতে হবে।"
বড় ধাক্কা, তবে শেষ নয়
প্রতিযোগিতাটি মারাত্মক আঘাত পেলেও এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পডকাস্টার কলাম রো বলেন, "ইউরোভিশনের ইতিহাসে এটি একটি বড় ঝাঁকুনির দিন।" ভক্তরা এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
রো মনে করেন, আগামী মে মাসে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার আগে বয়কটকারী দেশগুলো সিদ্ধান্ত বদলাবে না।
ইউরোভিশন পরিচালক মার্টিন গ্রিন ধারণা করছেন, আগামী বছর ভিয়েনায় ৩৫টি দেশ অংশ নেবে। চারটি দেশ চলে গেলেও মলদোভা, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া ফিরে আসছে।
এই বিরোধের ছায়া আগামী বছরগুলোতেও থাকবে। সংগীত জগতের অনেকেই ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিচ্ছেন। তাই ইসরায়েলের সঙ্গে একই মঞ্চে গান গাইতে শিল্পী পাওয়া কঠিন হতে পারে। প্রতিযোগিতার স্লোগান ছিল "গানে গানে একতা" বা 'ইউনাইটেড বাই মিউজিক'। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই স্লোগানটি যেন ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ওয়েইসম্যান আশাবাদী যে ইউরোভিশন টিকে থাকবে। তিনি বলেন, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১০ বছর পর এটি চালু হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে সংকট ও যুদ্ধের মধ্যে একে অপরের কথা শোনা এবং গণতান্ত্রিক পথ বের করাই আমাদের দায়িত্ব।"
তবে বৃহস্পতিবার যে ফাটল ধরেছে, তা জোড়া লাগানো এখন বেশ কঠিন।
