চীনের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকগুলো কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানি-লন্ডারিং নেটওয়ার্কে পরিণত হলো
চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধ যেসব শিল্পে প্রবেশ করেছে, সেসব ক্ষেত্রেই তারা প্রায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে—হোক তা ইস্পাত, জাহাজ, ব্যাটারি বা বৈদ্যুতিক যানবাহন। তারা খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ায় এবং ধনী দেশগুলোর শিল্প খাতে বিশাল চাপ সৃষ্টি করে, যাদের স্থানীয় উৎপাদন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এখন চীনা আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবৈধ খাতগুলোর একটি— আন্তর্জাতিক অর্থপাচার নেটওয়ার্কও দখলে নিয়ে নিচ্ছে। এই খাত মাদক পাচার থেকে শুরু করে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের ক্রিপ্টোকারেন্সি চুরির মতো অপরাধকে সহায়তা করে।
মানি-লন্ডারাররা কত বড় একটি শিল্প পরিচালনা করে তার সঠিক পরিমাপ পাওয়া কঠিন, কারণ বৈধ খাতের মতো এদের ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন নেই। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৫৪ বিলিয়ন ডলার অবৈধ অর্থ—মূলত মেক্সিকোভিত্তিক কার্টেলদের হাতে আমেরিকায় বিক্রি হওয়া মাদকের অর্থ—চীনের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে চীনা নেটওয়ার্কগুলো আমেরিকায় অবৈধ মাদকের মোট অর্থের বড় অংশই লেনদেন করছে। ব্যুরো অব ইকনোমিক এনালাইসিসের ২০১৭ সালের এক গবেষণায় এই অঙ্ক ছিল ১৫৩ বিলিয়ন ডলার। "চীনা মানি-লন্ডারিং নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ও প্রভাবশালী," আগস্টে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে লিখেছিলেন, মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক (ফিনসেন) -এর পরিচালক আন্দ্রিয়া গ্যাকি।
যেভাবে অন্যান্য চীনা শিল্প নতুন বিদেশি বাজার দখল করে, চীনা মানি-লন্ডারাররাও একইভাবে প্রতিযোগীদের সরিয়ে দিয়েছে—কম খরচ এবং উদ্ভাবন দিয়ে। পুরনো অর্থপাচার পদ্ধতিগুলো চীনা নেটওয়ার্কের দক্ষতা, বিস্তৃতি এবং কম ফি-র সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। অতীতে মেক্সিকোর মাদক পাচারকারীরা 'ব্ল্যাক মার্কেট পেসো এক্সচেঞ্জ' ব্যবহার করত—যেখানে পাচারকারীদের ডলার দিয়ে আমেরিকা থেকে পণ্য কিনে মেক্সিকোতে পাঠানো হতো, পরে সেগুলো বিক্রি করে পেসো পাওয়া যেত। কার্টেল-সম্পৃক্ত হওয়ায় এসব নেটওয়ার্কে সহিংসতা, চুরি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপের ঝুঁকি সবসময়ই থাকত, বললেন আমেরিকার ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি- ডিইএ -এর সাবেক কর্মকর্তা ক্রিস আরবেন। আগে লন্ডারাররা ৭–১০ শতাংশ পর্যন্ত ফি নিত। কিন্তু নতুন চীনা নেটওয়ার্ক ফি নামিয়ে আনে ১ থেকে ২ শতাংশে। এর ফলে তারা "রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মতো" পুরো নেটওয়ার্ক দখল করে নেয়, মন্তব্য করেন আরবেন।
এরা বিপুল পরিসরে কাজ করতে সক্ষম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্রিপ্টোকারেন্সি ডাকাতিতে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার চুরি করে। তারা দিনে প্রায় ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত পাচার করতে পেরেছিল বলে জানায় একটি তদন্ত সংস্থা- টিআরএম। ধারণা করা হয়, এতে চীনা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকাররা সহযোগিতা করেছিল—অবৈধ অর্থকে ছোট ছোট লেনদেনে ভেঙে বৈধ অর্থ লেনদেন ও বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছিল।
চীনা মানি-লন্ডারিং নেটওয়ার্কের সাফল্যের পেছনে রয়েছে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, চীনের বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত, এবং সবচেয়ে বড় কারণ—চীনের কড়াকড়ি মূলধন নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণে কেউ বছরে ৫০ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারে না। ফলে অবৈধ পথে অর্থ বাইরে নিতে চায় অনেকে। আলোচিত তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এক ধরণের ত্রিপাক্ষিক বাণিজ্য চক্র—যেখানে মাদক পাচারকারীরা আমেরিকা বা ব্রিটেন থেকে অবৈধ ডলার বের করতে পারে, চীনারা তাদের ইউয়ান দেশ থেকে বাইরে নিতে পারে, এবং সেই অর্থকে পেসো কিংবা অন্যান্য মুদ্রায় রূপান্তর করা যায়, যা মাদক ব্যবসায়ী কার্টেলদের প্রয়োজন।
প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্য সবচেয়ে পরিচিত পদ্ধতি 'মিরর ট্রানজ্যাকশন'-কে ধরুন। এর ধাপগুলো খুব সহজ। প্রথম ধাপ—কার্টেল কোকেন বা অন্য মাদক আমেরিকায় পাঠায় এবং সেগুলো বিক্রি হয়ে প্রচুর ডলার আসে। এবার কল্পনা করুন, সাংহাইয়ের এক ধনী মা তার নিউইয়র্কে পড়ুয়া ছেলের জন্য একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান। তিনি অনলাইনে এক ব্রোকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, যিনি তাকে ডলার বিক্রি করতে ইচ্ছুক এক ব্যক্তির সঙ্গে মেলালেন। ওই নারী ব্রোকারের কথামতো তার নিয়ন্ত্রিত একটি চীনা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ইউয়ান পাঠালেন। একই সময়ে ব্রোকার ব্যবস্থা করলেন যেন সেই পরিমাণ ডলার (ফি কেটে) আমেরিকায় ওই নারীর এক্সেস আছে এমন একটি অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। ফলে অতিক্রম না করেই অর্থ আন্তসীমান্ত লেনদেন হয়ে গেল।
তৃতীয় ধাপে ব্রোকারকে কার্টেলকে তাদের চাহিদামতো মুদ্রায় অর্থ ফেরত দিতে হয়। চীনে প্রাপ্ত ইউয়ানের কিছু অংশ দিয়ে মেক্সিকোয় ফেন্টানিল তৈরির কাঁচামাল কেনা হতে পারে। অথবা এই ইউয়ান দিয়ে বৈধ চীনা পণ্য কেনা হয়, যা পরে মেক্সিকো বা অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয় এবং সেই দেশের মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়। কোনো কাগজপত্রে এই লেনদেনের ছাপ থাকে না—শুধু হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের কথোপকথন ছাড়া, যেগুলো এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপটেড। মার্কিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এগুলোতে প্রবেশ করতে পারে না। "আমরা যেন আবার পাথরযুগে ফিরে গেছি," মন্তব্য করেন আরবেন।
আশির দশকে কলম্বিয়ান কার্টেলদের গড়া আগের মানি-লন্ডারিং নেটওয়ার্কগুলো আমেরিকা ও কলম্বিয়া সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা, আটক ও সম্পদ জব্দের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু চীনা নেটওয়ার্ককে ভাঙা কঠিন হবে। কারণ এগুলো আরও বেশি দেশে বিস্তৃত, অপরাধীদের পাশাপাশি ধনীদেরও সেবা দেয় এবং ভিন্ন ভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থার শূন্যস্থানগুলোতে কাজ করে। তাছাড়া তারা একাধিক আন্ডারগ্রাউন্ড শিল্পকে সেবা দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা গ্যাং পরিচালিত অনলাইন প্রতারণা শিল্প বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ তৈরি করছে। এর কিছু পুনর্বিনিয়োগ হলেও এর বড় অংশ পাচার করতে হয়।
মিরর ট্রানজ্যাকশনের পাশাপাশি নানান উপায়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকগুলো অবৈধ তহবিলকে বৈধ রূপ দিতে পারে। কখনো ভুয়া চালান বা অস্তিত্বহীন পণ্য রপ্তানির কাগজ দেখানো হয়। কখনো ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্থ ধৌত করা হয়। ২০০০ সালের গোড়ায় ধনী চীনারা 'জাঙ্কেট' নামের মধ্যস্থতাকারীদের ইউয়ান দিত, যারা ম্যাকাউয়ের ক্যাসিনোতে তাদের ভ্রমণের ব্যবস্থা করত। সেখানে পৌঁছালে তারা চিপ পেত। কয়েকটি ছোট বাজি ধরার পর তারা "জেতা" টাকাকে হংকং ডলারে বদলে হংকংয়ের ব্যাংকে জমা করতে পারত।
মানি-লন্ডারাররা সাধারণত একাধিক পদ্ধতির সংমিশ্রণ ব্যবহার করে। একটি কেস দেখায় অপরাধীরা কত বড় অবকাঠামো তৈরি করেছে। গত অক্টোবর মার্কিন প্রসিকিউটররা কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ী চেন ঝির বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত প্রিন্স গ্রুপ প্রকাশ্যে রিয়েল এস্টেট ও আর্থিক সেবার ব্যবসা করলেও– তলে তলে এটি ছিল এশিয়ার অন্যতম বড় অপরাধ সাম্রাজ্য—এমন অভিযোগ প্রসিকিউটরদের। চেন, যিনি চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ২০১২ সালে চীনে দুর্নীতি দমন অভিযানের পর বহু অপরাধীর মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পালিয়ে যান। প্রিন্স গ্রুপ ২০১৮ সালেই অনলাইন প্রতারণা থেকে দিনে ৩০ মিলিয়ন ডলার আয় করছিল। ২০২০ সালের মধ্যে চেনের মালিকানায় ১,২৭,২৭১ বিটকয়েন জমা হয়—যার মূল্য এক মাস আগে জব্দের সময় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থ বৈধ করার জন্য তিনি বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতেন—ক্রিপ্টো মাইনিং ফার্ম, অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্ম, শেল কোম্পানি এবং বৈধ ব্যবসার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হতো লন্ডারিং সেবা। প্রিন্স গ্রুপ ও চেন যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চীনের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকিং সিস্টেমে বৈধ ব্যবসাকে অবৈধ অর্থ ধোয়ার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার এই কৌশল ব্যাপক। হুইয়োন গ্যারান্টি +, যা ২০২১ সালের দিকে একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস হিসেবে যাত্রা শুরু করে, সম্পত্তি, গাড়ি ও বিভিন্ন পণ্য বেচাকেনা করত। ব্লকচেইন বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এলিপটিক জানায়, এটি বছরে বিলিয়ন ডলারের লেনদেন করত। কিন্তু পাশাপাশি এটি ছিল অপরাধীদের এক ধরনের 'ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেন্টার'—একটি ফেসবুক মার্কেটপ্লেসের মতো, যেখানে প্রতারণা-বাণিজ্যও চলত। (হুইয়োন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।)
গত অক্টোবরে মার্কিন অর্থ বিভাগ হুইয়োন গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমেরিকার ব্যাংকিং সিস্টেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এ অভিযোগ তুলে যে, এটি উত্তর কোরিয়ার সাইবার ডাকাতির অর্থ বৈধকরণের "গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র"। এছাড়া "পিগ বাচারিং" নামে পরিচিত অনলাইন আর্থিক প্রতারণার অর্থও বৈধকরণের অভিযোগ রয়েছে। ট্রেজারি বলেছে, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলার অবৈধ অর্থ সরিয়েছে।
তবে সব কাজ অনলাইনে হয় না। যখন নগদ অর্থকে বৈধ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঢোকানোর প্রয়োজন হয়, তখন লন্ডারাররা অর্থ-বাহক বা মানি মিউল নিয়োগ করে—সাধারণত অল্পবয়সী বা দরিদ্র মানুষ যাদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, যাতে অপরাধীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে পারে। ২০২২ সালে সিঙ্গাপুরে ড্যানিয়েল (ছদ্মনাম) নামের এক তরুণ বাসন ধোয়ার কাজ করতেন। তার এক বন্ধু তাকে কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিলে ৬০০ ডলার আয় করতে বলেছিল—যা ছিল তার মাসিক আয়ের দ্বিগুণ। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি লাখ লাখ ডলারের লেনদেনসহ ব্যাংক স্টেটমেন্ট পেতে থাকেন। তার পরিচিত আরও পাঁচজন একইভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে অর্থপাচার চক্রের জালে জড়ানো ড্যানিয়েল শেষপর্যন্ত জেল এড়াতে পেরেছিলেন—তবে এজন্য তার কিছু বন্ধুকে কারাবরণ করতে হয়।
এমন কৌশল অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে। ব্রিটেনের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টকে জানিয়েছে, চীনা অপরাধী নেটওয়ার্কগুলো ব্রিটিশ ব্যাংকে চীনা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থপাচার করে। কখনো কখনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংক কর্মীরাও ভুয়া ঠিকানায় অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। এমনই এক ঘটনায় ব্যাংক অব আমেরিকা নিজস্ব মনিটরিং সিস্টেমে অবৈধ লেনদেন শনাক্ত করে কর্মীদের বরখাস্ত করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো যখন এসব নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলভাবে বিচারও করছে—তবুও এটি মূলত লুকোচুরি খেলার মতোই। একটি ফাঁক বন্ধ করলে, অন্য ফাঁক দিয়ে অর্থপাচার ঠিকই হয়। তাই এ শিল্পকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে চীন সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য—কিন্তু বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই সহযোগিতা বড়ই দুর্লভ।
