ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য’ ঘোষণা করল ট্রাম্প প্রশাসন
সোমবার থেকে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আরও বাড়ল ট্রাম্প প্রশাসনের। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং তার সরকারের ঘনিষ্ঠদের একটি 'বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন'-এর সদস্য ঘোষণা করেছে।
'কার্টেল দে লস সোলস' নামের এ সংগঠনকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার ফলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন মাদুরোর সম্পদ ও অবকাঠামোর ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতা পেলেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, 'কার্টেল দে লস সোলস' নামটি মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়; এটি কোনো সংগঠিত অপরাধী চক্র নয়।
আইন বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এই ঘোষণার ফলে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের সরাসরি অনুমতি পাওয়া যাবে না।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দাবি, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসবিরোধী অন্যতম কঠোর এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে সামরিক অভিযানের পথ আরও উন্মুক্ত করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদক পাচারে জড়িত ভেনেজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরের একটি বিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ককে বোঝাতে 'কার্টেল দে লস সোলস' নামটি ব্যবহার করা হয়। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো বরাবরই মাদক পাচারে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার সরকারও বারবার বলেছে, কথিত এই কার্টেলের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি কিছু বিশেষজ্ঞও মনে করেন, প্রচলিত অর্থে এমন কোনো কার্টেল আদৌ নেই।
গত ১৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণাটি এমন এক সময়ে আসে, যখন এর আগেই পেন্টাগন ওই অঞ্চলে 'অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার' নামে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে এক ডজনেরও বেশি যুদ্ধজাহাজ এবং ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। মাদক পাচারবিরোধী এই অভিযানের আওতায় নৌকায় হামলা চালিয়ে মার্কিন বাহিনী ইতোমধ্যে বহু মানুষকে হত্যা করেছে।
ভেনেজুয়েলার ভেতরে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেছেন। সম্ভাব্য বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে— সামরিক বা সরকারি স্থাপনায় হামলা, বিশেষ অভিযান এবং অন্যান্য আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ। তবে কোনো কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার পথও এখনো খোলা রাখা হয়েছে।
এদিকে, ক্যারিবিয়ান সাগরে অভিযানে সহায়তাকারী সেনাসদস্যদের ধন্যবাদ জানাতে সোমবার পুয়ের্তো রিকো সফরে যাচ্ছেন জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন এবং তার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ডেভিড আইসম।
তবে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে মার্কিন জনমনে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। রোববার প্রকাশিত সিবিএস নিউজ ও ইউগভ-এর এক যৌথ জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ আমেরিকান ভেনেজুয়েলায় সামরিক পদক্ষেপের বিপক্ষে। মাত্র ৩০ শতাংশ এর পক্ষে মত দিয়েছেন। এছাড়া ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, তারা অবৈধ অভিবাসন ও মাদক প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যেই কাজ করছে। তবে এসব প্রচেষ্টার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ভেনেজুয়েলায় ক্ষমতার পালাবদল বা 'রেজিম চেঞ্জ' ঘটতে পারে। এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্প আশা করছেন যে সরাসরি সামরিক হামলা ছাড়া শুধুই চাপের মুখে মাদুরো পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন।
অন্যদিকে, ভেনেজুয়েলা সরকার এক বিবৃতিতে কার্টেলকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার বিষয়টি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একে 'হাস্যকর ও বানোয়াট গল্প' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, 'আমাদের দেশের বিরুদ্ধে অতীতে বারবার চালানো আগ্রাসনের মতোই এই নতুন কৌশলের ফলও হবে একই— ব্যর্থতা।'
তবে কূটনৈতিক সমাধানের পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দেননি ট্রাম্প। গত সপ্তাহে তিনি বলেছিলেন, মাদুরো 'কথা বলতে চান'। পরে তিনি ইঙ্গিত দেন, 'উপযুক্ত সময়ে' তিনিও ভেনেজুয়েলার নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাদুরো এবং তার ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য যোগাযোগব্যবস্থা কেমন হতে পারে, সে নিয়েও আলোচনা চলছে। এমনকি ট্রাম্পের সামনে মাদুরোর সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের একটি প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। তবে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
ট্রাম্প ও মাদুরোর সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে সিএনএন যোগাযোগ করলেও, হোয়াইট হাউস তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
উত্তেজনা বৃদ্ধির আরও একটি ইঙ্গিত মিলেছে গত বৃহস্পতিবার। ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অন্যতম বৃহত্তম সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেছে। সিএনএন-এর ফ্লাইট ডেটা বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কয়েক ঘণ্টা ধরে দেশটির উপকূলের ওপর অন্তত ছয়টি মার্কিন সামরিক বিমান চক্কর দেয়। এর মধ্যে ছিল সুপারসনিক এফ/এ–১৮ই যুদ্ধবিমান, বি-৫২ স্ট্র্যাটেজিক বোম্বার এবং নজরদারি বিমান।
এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সপ্তাহান্তে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা ভেনেজুয়েলা থেকে তাদের ফ্লাইট বাতিল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বড় এয়ারলাইনগুলোকে ভেনেজুয়েলার আকাশসীমায় 'সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি' সম্পর্কে সতর্ক করার পরই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
