১৬ বছরের কম বয়সিদের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, কার্যকর হবে যেভাবে
১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। কিশোর-কিশোরীদের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
সরকার জানায়, শিশুদের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের 'চাপ ও ঝুঁকি' কমাতেই এই সিদ্ধান্ত। তাদের মতে, প্ল্যাটফর্মগুলোর নকশা শিশুদের অতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে আটকে রাখে এবং এমন অনেক বিষয়বস্তু দেখায়, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
সরকার-পৃষ্ঠপোষকতায় করা চলতি বছরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটির ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী ৯৬ শতাংশ শিশু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে সাত জনই নারীবিদ্বেষ, মারামারি, খাদ্যাভ্যাসজনিত সমস্যা, আত্মহত্যা উসকে দেওয়া কনটেন্টসহ নানা ক্ষতিকর বিষয়বস্তু ও আচরণের মুখোমুখি হয়েছে। প্রতি সাত জনে একজন 'গ্রুমিং'-এর শিকার এবং অর্ধেকের বেশি শিশু সাইবারবুলিংয়ের অভিজ্ঞতা পেয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, থ্রেডস, টিকটক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউব, রেডিটসহ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম কিক ও টুইচ এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকবে।
তবে অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্মগুলোকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার দাবিতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। রোবলক্স ও ডিসকর্ডসহ বেশ কিছু গেমিং প্ল্যাটফর্ম ইতোমধ্যে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় কিছু ফিচারে বয়স যাচাই ব্যবস্থা চালু করেছে।
সরকার জানায়, কোনো প্ল্যাটফর্ম নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে কি না—তা নির্ধারণে তিনটি মানদণ্ড বিবেচনা করা হবে: প্ল্যাটফর্মটির মূল লক্ষ্য সামাজিক মিথস্ক্রিয়া কি না, ব্যবহারকারীরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে কি না, এবং ব্যবহারকারীরা কনটেন্ট পোস্ট করতে পারে কি না। এসব মানদণ্ড পূরণ না করায় ইউটিউব কিডস, গুগল ক্লাসরুম ও হোয়াটসঅ্যাপ এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকছে।
নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলেও শিশু বা অভিভাবকদের কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হবে না। এই নিয়ম কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর ওপর। গুরুতর বা বারবার নিয়ম ভাঙলে এসব কোম্পানিকে সর্বোচ্চ ৩২ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হতে পারে।
সরকার আরও জানিয়েছে, শিশুদের প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে রাখতে কোম্পানিগুলোকে 'যৌক্তিক পদক্ষেপ' নিতে হবে। এজন্য বয়স নিশ্চিতকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। সরকারি আইডি যাচাই, চেহারা বা কণ্ঠ শনাক্তকরণ এবং 'এইজ ইনফারেন্স' (বয়স অনুমান) প্রযুক্তিও এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
প্ল্যাটফর্মগুলোকে কেবল ব্যবহারকারীদের দেওয়া বয়স বা অভিভাবকদের সম্মতির ওপর নির্ভর না করে একাধিক পদ্ধতিতে বয়স যাচাই করতে উৎসাহিত করেছে সরকার।
মেটা জানিয়েছে, তারা ৪ ডিসেম্বর থেকে কিশোর-কিশোরীদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা শুরু করবে। ভুলবশত যাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে, তারা সরকারি আইডি বা ভিডিও সেলফির মাধ্যমে বয়স নিশ্চিত করতে পারবে। তবে অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো নিজেদের কর্মপন্থা ঘোষণা করেনি।
নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বয়স যাচাই প্রযুক্তি ভুলভাবে কিছু ব্যবহারকারীকে ব্লক করতে পারে এবং একই সঙ্গে কমবয়সীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েছে। জরিমানার কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। ফেসবুকের সাবেক নির্বাহী স্টিফেন শিলার বলেছেন, 'মেটার ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে মাত্র এক ঘণ্টা ৫২ মিনিট লাগে।' সমালোচকদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞা ডেটিং সাইট, গেমিং প্ল্যাটফর্ম ও এআই চ্যাটবটের মতো অন্যান্য অনলাইন ঝুঁকি অন্তর্ভুক্ত করেনি। যোগাযোগমন্ত্রী অ্যানিকা ওয়েলসও স্বীকার করেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা 'নিখুঁত' নাও হতে পারে।
এদিকে বিপুল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিয়ে গোপনীয়তার উদ্বেগ বাড়ছে। তবে সরকার বলছে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় 'শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা' রাখা হয়েছে এবং এসব তথ্য বয়স যাচাইকরণ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে না।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তাদের দাবি, নিয়মটি বাস্তবায়ন কঠিন হবে, সহজে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, ব্যবহারকারীদের জন্য ঝামেলাপূর্ণ এবং গোপনীয়তার ঝুঁকিও তৈরি করবে। তারা আরও সতর্ক করেছে, এতে শিশুরা ইন্টারনেটের আরও ঝুঁকিপূর্ণ কোণায় ঠেলে যেতে পারে এবং তরুণদের সামাজিক যোগাযোগ ব্যাহত হবে।
গুগল (ইউটিউবের মূল প্রতিষ্ঠান) নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করবে কি না—তা এখনও বিবেচনা করছে। মেটা এই পদক্ষেপকে 'কিশোর-কিশোরীদের জন্য অসঙ্গতিপূর্ণ সুরক্ষা' বলে মন্তব্য করেছে।
১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার অস্ট্রেলিয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বে প্রথম। এর বাইরে যুক্তরাজ্যে নতুন নিরাপত্তা বিধি কার্যকর আছে, যেখানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের অবৈধ বা ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে বড় অঙ্কের জরিমানা বা নির্বাহীদের কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও স্পেনসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ১৫ বা ১৬ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সম্মতি সাপেক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের অনুমতি বা সরাসরি নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ অঙ্গরাজ্যে ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য অভিভাবকদের সম্মতি ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার উদ্যোগটি গত বছর ফেডারেল আদালত সাময়িকভাবে আটকে দিয়েছিল।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অনেক কিশোর-কিশোরী বলেছে, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগেই তারা মিথ্যা বয়স দিয়ে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলছে। সরকার অবশ্য কোম্পানিগুলোকে এসব অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে মুছে ফেলতে বলেছে।
এদিকে অনলাইনে কিশোর-কিশোরীরা বিকল্প অ্যাপ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে বা নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর টিপস শেয়ার করছে। কেউ কেউ অভিভাবকদের সঙ্গে যৌথ অ্যাকাউন্ট খুলছে। অনেক মন্তব্যকারী বলছেন, ভিপিএন ব্যবহারের প্রবণতাও বাড়তে পারে—যেমনটি যুক্তরাজ্যে বয়স-নিয়ন্ত্রণ বিধি কার্যকরের পর দেখা গিয়েছিল।
