পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিতে ইমরান খান ও পিটিআইকে নিষিদ্ধের প্রস্তাব পাস
পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন এবং বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। এর মধ্যেই মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলি একটি প্রস্তাব পাস করেছে, যেখানে কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার দল পিটিআইকে রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী ইমরান খানের নাম উল্লেখ না করেই তার কড়া সমালোচনা করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ইমরান খান সেনাবাহিনী বিরোধী ন্যারেটিভ তৈরি ও প্রচার করছেন, যা রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনার কয়েক দিন পরেই পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিতে এই প্রস্তাবটি পাস হলো।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের ওই বক্তব্যের পর থেকেই পিএমএল-এন এবং পিটিআই নেতাদের মধ্যে তুমুল বাকযুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ইমরান খান অতীতে বিরোধী দলের নেতাদের উদ্দেশে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাই সেনা মুখপাত্রের মন্তব্যে আপত্তি জানানোর কোনো অধিকার তার নেই।
অন্যদিকে, পিটিআই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর মন্তব্যকে হাস্যকর অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দলটির দাবি, ইমরান খান কোনোভাবেই নিরাপত্তা হুমকি নন।
পিএমএল-এন এর আইনপ্রণেতা তাহির পারভেজ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে ইমরান খানের সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পিটিআই আইনপ্রণেতারা অধিবেশন বর্জন করেন। তাদের অনুপস্থিতিতেই সরকারি দলের সদস্যদের সমর্থনে প্রস্তাবটি পাস হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিটি ফ্রন্টে পাকিস্তানকে রক্ষা করে এবং ভারতের মতো পাঁচগুণ বড় শত্রুকে সফলভাবে মোকাবিলা করেছে, তারা দেশের অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।'
এতে আরও বলা হয়, 'শত্রু রাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য রাজনৈতিক দল (পিটিআই) এবং এর প্রতিষ্ঠাতা নেতার (ইমরান খান) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। দলটির প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে দেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া এবং বিশৃঙ্খলা ছড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে।'
প্রস্তাবে দাবি জানানো হয়, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক—যেকোনো দলের নেতার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাও জানানো হয় এই প্রস্তাবে। তবে এই প্রস্তাবে নির্দিষ্ট করে পিটিআই বা ইমরান খানের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।
এদিকে, পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পাঞ্জাবের তথ্যমন্ত্রী আজমা বোখারি বলেন, 'তিনি কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ বা কোনো প্রদেশে গভর্নরের শাসন জারির পক্ষে নন। তবে তিনি সতর্ক করে দেন, পিটিআইয়ের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড কর্তৃপক্ষকে সেই দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'পিটিআই যদি তাদের পথ পরিবর্তন না করে, তবে সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করা বা গভর্নরের শাসন জারির মতো বিকল্পগুলো বিবেচনা করতে পারে।'
ইমরান খানের কঠোর সমালোচনা করে বোখারি বলেন, 'আদিয়ালা জেলের বন্দী এখন কার্যত আলতাফ হোসেন পার্ট টু-তে পরিণত হয়েছেন। পাকিস্তান-ভারত সংঘাতের সময় পিটিআই প্রতিষ্ঠাতার নীরবতা ছিল রাষ্ট্রবিরোধী আচরণের শামিল। পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তান আর একসাথে এগিয়ে যেতে পারে না।'
তিনি অভিযোগ করেন, 'ইমরান খান পাকিস্তানকে বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন এবং দেশের বদনামে লিপ্ত হয়েছেন।' তিনি দাবি করেন, 'সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা চালানোর জন্য বিদেশে অবস্থিত একটি সেল ব্যবহার করা হচ্ছে।' তিনি আরও যোগ করেন, 'পিটিআই নেতারা রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারে ব্যস্ত থেকে প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীকে রাজনীতির মধ্যে টেনে আনার চেষ্টা করছেন। এমনকি পিটিআই-এর মধ্যেও অনেকে এই নীতি নিয়ে বিরক্ত।'
অন্যদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইমরান খানের বোনদের নেতৃত্বে আদিয়ালা জেলের কাছে অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত ছিল।
সেখানে পিটিআই-এর মহাসচিব সালমান আকরাম রাজা এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া পিটিআই-এর সভাপতি জুনায়েদ আকবর খানসহ দলের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
পিটিআই বারবার তাদের কারাবন্দী প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছে। প্রতি মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার দেখা করার ব্যাপারে আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও জেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে গত সপ্তাহে কর্তৃপক্ষ ইমরানের আরেক বোন উজমা খানকে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিয়েছিল। সাক্ষাৎ শেষে তিনি জানিয়েছিলেন, ইমরান খান সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
মঙ্গলবার কারাগারের দিকে যাওয়ার সময় ভিডিও বার্তায় আলিমা খান অভিযোগ করেন, রাষ্ট্র আইন লঙ্ঘন করছে, যেখানে পিটিআই বেআইনি কিছুই করেনি।
তিনি বলেন, 'তারা যদি বেআইনিভাবে কাজ করে আর আমরা আইন মেনে চলি, এবং এরপরও যদি তারা সঠিক আর আমরা ভুল হই, তবে তা আমাদের ব্যবস্থাটি কেমন, সেটাই প্রমাণ করে।' তিনি উল্লেখ করেন, 'গত ১৪ মাস ধরে ইমরান খানকে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না।'
অন্যদিকে, পুলিশ দুবার ইমরানের বোনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। পরে সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এরপর আলিমা গাড়ি থেকে নেমে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিশাল এক দল নিয়ে আদিয়ালা জেলের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। কারাগারের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আদিয়ালা রোডের গোরখপুর মার্কেটে দাঙ্গা পুলিশ তাদের আটকে দেয়।
পুলিশ ব্যারিকেডের সামনে বসে আলিমা আরেকটি ভিডিও বার্তা দেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'এটি অসাংবিধানিক ও বেআইনি। কেন তারা ইমরান খানকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এবং নির্যাতন করছে? এই লোকেরা সংবিধান লঙ্ঘন করছে এবং আইন অমান্য করছে।'
আলিমা আরও বলেন, 'আমরা এখান থেকে নড়ব না তারা আমাদের লাঠিপেটা করতে পারে বা গুলি করতে পারে। তোমাদের যা ইচ্ছা করো।'
এদিকে, কারাগারের কিছুটা দূরে দাহগালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গহর আলী খান। তিনি পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
ব্যারিস্টার গহর যুক্তি দেন, 'এখানে আসার অধিকার আমাদের আছে এবং এ বিষয়ে আদালতের আদেশও রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমরা অনেক কিছুই করার চেষ্টা করছি, কিন্তু সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে যদি আমাদের দেখা করতে দেওয়া হয়, যদি তাকে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'দেশে বিভাজন থাকা উচিত নয়। রাজনীতিতে মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু তা যেন শত্রুতায় রূপ না নেয়।' পিটিআই প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে দেখা না করেই তিনি এলাকা ত্যাগ করেন।
পিটিআই মহাসচিব রাজা বলেন, 'ইমরান খানের বোনদের তার সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেওয়ার কোনো অজুহাত হতে পারে না।' তিনি বলেন, 'ইমরান খানের বার্তা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—এই অজুহাতে কেউ দেখা করার অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।'
পিটিআই-এর প্রাদেশিক সভাপতি আকবর বলেন, 'সিনেটর ফয়সাল ভাওদার চ্যালেঞ্জের কারণেই বিপুল সংখ্যক দলীয় কর্মী ও সমর্থক আদিয়ালা জেলে পৌঁছেছেন।'
আকবর বলেন, 'আমরা প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি এবং সারারাত এখানে বসে থাকতে রাজি আছি। আমরা আশা করি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে৷ আমরা দীর্ঘ অবস্থান কর্মসূচির জন্য প্রস্তুত আছি৷।' তিনি যোগ করেন, 'জনগণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে।'
