বিহার নির্বাচন: ভারতের সবচেয়ে তরুণ রাজ্যে ‘জেন-জি’ প্রজন্মের ক্ষোভ কি সামলাতে পারবেন মোদি?
মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ ২০ বছর বয়সী অজয় কুমারের চোখে পড়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অনিয়ম হওয়ার একটি খবর। যে পরীক্ষায় তিনিও অংশ নিয়েছিলেন, তার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে।
দলিত সম্প্রদায়ের তরুণ অজয়ের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বোনা ছিল এই একটি চাকরিকে ঘিরেই। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে প্রশ্নফাঁসের খবর সেই স্বপ্নে একরকম কুঠারাঘাত করে।
এর কিছুদিন পরই তিনি একটি ভিডিও দেখেন, যেখানে তার বয়সী ক্ষুব্ধ তরুণেরা রাজধানী পাটনায় বিক্ষোভ করছেন। মুজাফফরপুর জেলা থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের সেই বিক্ষোভে যোগ দিতে এক মুহূর্ত ভাবেননি অজয়। রাতের বাস ধরে পাটনায় পৌঁছে পরের দিন সকালেই তিনি যোগ দেন হাজারো শিক্ষার্থীর সেই প্রতিবাদে।
পরবর্তী ১০০ দিন হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে শত শত শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিবাদ চালিয়ে গেছেন অজয়। তাদের দাবি ছিল একটাই; পুনরায় পরীক্ষা নিতে হবে।
কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দিলে তাদের সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
সেই ক্ষোভ আর হতাশা কয়েক মাস ধরে পুষে রেখেছিলেন অজয়। অবশেষে গেল ৬ নভেম্বর, বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ভোট দেওয়ার সময় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের বোতামটি তিনি চেপে ধরেন শক্ত করে। তার আশা, এই একটি ভোটই তার মতো লাখো তরুণের বঞ্চনার 'প্রতিশোধ' নেবে।
ভারতের সবচেয়ে তরুণ রাজ্যের ক্ষোভ
জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে সরকার উৎখাত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত ব্যতিক্রম। ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের ক্ষমতায় আছে দেশটির হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে বিহারেও গত দুই দশকে বেশির ভাগ সময় বিজেপি ও তার অংশীদারদের জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বিহারের জনসংখ্যা সবচেয়ে তরুণ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং ২৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।
কিন্তু তারুণ্যের এই প্রাচুর্যের সঙ্গে মিশে আছে চরম দারিদ্র্য। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বিহারের প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে একটি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে, যা রাজ্যটিকে ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যের তকমা দিয়েছে।
পুষ্টি, শিশু মৃত্যুহার, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবাসহ ভারতের বহুমাত্রিক মানব উন্নয়ন সূচকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা দেশের মধ্যে বিহারের অবস্থান তলানিতে।
চাকরির অভাব, দুর্নীতি আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তরুণদের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, তা বারবার প্রকাশ পেয়েছে রাজপথে। সরকারি হিসাব মতেই, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিহারে প্রায় ৪০০টি বিক্ষোভ হয়েছে, যা সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। অজয়ের মতো অনেকেই এখন সেই ক্ষোভকে ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনে রূপ দিতে চাইছেন।
গত ৬ এবং ১১ নভেম্বর—এই দুই ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিহারের ৭ কোটির বেশি ভোটার তাদের রায় দিয়েছেন। ফলাফল ঘোষণা করা হবে আজ ১৪ নভেম্বর।
ভোট গণনার প্রাথমিক আভাসে এনডিএ জোট অনেকটাই এগিয়ে আছে। বেশ পিছিয়ে বিরোধী মহাজোট।
বিহার বিধানসভার মোট আসন ২৪৩টি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ১২২ আসন। ভোট গণনার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, এনডিএ জোট এগিয়ে থাকা আসনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সীমা পেরিয়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনের ফলাফলই বলে দেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর তার প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছেন কি না। অন্যদিকে, বিহারভিত্তিক রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) তরুণ নেতা তেজস্বী যাদব এবং কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর জোট কি তরুণদের এই হতাশা কাজে লাগাতে পারবে, সেই উত্তরও মিলবে এই ফলাফলে।
প্রতিশ্রুতিভঙ্গের বেদনা
অজয়ের মতোই দলিত সম্প্রদায়ের তরুণী কোমল। তার পরিবার চলে মায়ের ৯ হাজার রুপি বেতনে, যিনি একজন অঙ্গনওয়াড়ী কর্মী। ২০২১ সালে বিহার সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রাজ্যের কোনো মেয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলে তাকে ৫০ হাজার রুপি নগদ অনুদান দেওয়া হবে। সেই আশাতেই বুক বেঁধেছিলেন কোমল।
২০২৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করার পর দুই বছর কেটে গেলেও সেই টাকা এখনো পাননি তিনি। তার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার, যার জন্য প্রয়োজন দুই বছরের বি.এড ডিগ্রি। কিন্তু প্রায় ৭৫ হাজার রুপির এই কোর্সে ভর্তি হওয়ার মতো সঞ্চয় তার নেই।
তিনি বলেন, 'আমি এতগুলো টাকা খরচ করে পড়াশোনা করেছি শুধু সরকারের ওই প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে। তারা যদি সময়মতো টাকাটা দিত, আমার দুটো বছর এভাবে নষ্ট হতো না।'
পাটনার একটি জনপ্রিয় কোচিং সেন্টারের মালিক রমাংশু মিশ্র বলেন, 'এখানকার শিক্ষার্থীরা সব সময়ই ক্ষুব্ধ। পড়াশোনার সময় তারা দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে হতাশ থাকে, আর পড়াশোনা শেষে চাকরির অভাব নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়।'
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিহারের শহরাঞ্চলে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২২ শতাংশ, যা দেশটির জাতীয় গড়ের (১৪ দশমিক ৭ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি।
মোদি বনাম তরুণ নেতৃত্ব
বিহারের এই নির্বাচন মোদির বিজেপি এবং বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোট—উভয়ের জন্যই এক বড় পরীক্ষা। বিরোধী জোট ৩৬ বছর বয়সী তেজস্বী যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা ভরসা রাখছে ৭৫ বছর বয়সী মোদি এবং ৭৪ বছর বয়সী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের ওপর।
সাংবাদিক ও লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতে, 'এই ফলাফলই দেখিয়ে দেবে, ভারতের সবচেয়ে তরুণ রাজ্যটি কি তরুণ নেতৃত্বকে বেছে নেবে, নাকি অভিজ্ঞদের ওপরই আস্থা রাখবে।'
দুই পক্ষই তরুণদের মন জয়ে মরিয়া। নরেন্দ্র মোদি এক নির্বাচনী প্রচারে বলেন, তার সরকারের নীতির কারণেই এখন বিহারের তরুণেরা সামাজিক মাধ্যমে 'রিলস' বানিয়ে আয় করতে পারছে। অন্যদিকে, বিরোধী জোট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে ২০ দিনের মধ্যে প্রতিটি পরিবারকে একটি করে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে।
এই প্রতিশ্রুতির ডামাডোলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ভোটারদের সতর্ক করে দিয়ে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও তুলেছেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন বিজেপি বিতর্কিত ভোটার তালিকা সংশোধনের মাধ্যমে মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলো থেকে প্রায় ৩০ লাখ ভোটারের নাম বাদ দিয়েছে, যারা সাধারণত বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
