মোনালিসা, রোসেটা স্টোন বা স্টারি নাইটের মতো যে জাদুঘরে বাঁধাকপি দেখতে লাখো মানুষের ভিড়
প্যারিসের ল্যুভরে যেমন মোনালিসা, লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রোসেটা স্টোন; তাইপেইয়ের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়ামেরও আছে তেমন এক শিল্পকর্ম, যার আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন লাখো মানুষ।
তবে এটি কোনো জগৎবিখ্যাত চিত্রকর্ম বা বিশাল ভাস্কর্য নয়। বরং জেডাইট পাথরের তৈরি মাত্র সাত ইঞ্চি উচ্চতার একটি বাঁধাকপি, যার শৈল্পিক কারুকার্য, বিতর্কিত ইতিহাস আর প্রতীকী তাৎপর্য একে সাধারণ এক সবজি থেকে তুলে নিয়ে গেছে তাইওয়ানের অঘোষিত জাতীয় প্রতীকের মর্যাদায়।
সাদা ও সবুজ জেডাইট পাথর খোদাই করে তৈরি এই বাঁধাকপিটি দেখলে মনে হয়, যেন সদ্য শিশিরভেজা অবস্থায় মাঠ থেকে তুলে আনা হয়েছে। সবুজ পাতার ভাঁজে বসে আছে একটি ফড়িং ও একটি পঙ্গপাল। পাথরের স্বাভাবিক রং ও বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে পাতার শিরা ও ভাঁজগুলোকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ দর্শনার্থী তাইপেইয়ের এই জাদুঘরে আসেন। এর মধ্যে ঠিক কতজন শুধু 'জেডাইট বাঁধাকপি' দেখতে আসেন, তার হিসাব না থাকলেও ছবির জন্য অপেক্ষমাণ দীর্ঘ সারিই এর জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।
জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে ওয়েবসাইটে আগেভাগেই জানিয়ে দিতে হয়, কখন এই শিল্পকর্মটি 'সফরে' থাকবে, অর্থাৎ অন্য কোনো দেশে প্রদর্শনীতে যাবে, যাতে দর্শনার্থীরা এসে হতাশ না হন। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা পর্যটক ক্লোয়ি ওয়াং বলেন, 'ছবিতে একে ততটা জীবন্ত মনে হয় না, কিন্তু চোখের সামনে দেখলে এর আকর্ষণ বোঝা যায়।'
এই শিল্পকর্মের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে, একে প্রায়ই তাইওয়ানের 'জাতীয় সম্পদ' বলা হয়, যদিও সরকারিভাবে এটি সেই মর্যাদা পায়নি।
'জেডাইট ক্যাবেজ উইথ ইনসেক্টস' নামের এই শিল্পকর্মটি তাইওয়ানের জাদুঘরের অধিকাংশ নিদর্শনের মতোই মূলত বেইজিংয়ের ফরবিডেন সিটির রাজকীয় সংগ্রহে ছিল। চীনের গৃহযুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাই-শেকের সরকার প্রায় সাত লাখ প্রত্নবস্তুর সঙ্গে এটিও তাইওয়ানে নিয়ে আসে।
ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটির শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক হসু ইয়া-হুয়েই বলেন, এর ঝলমলে রং ও ভাস্করের নিপুণ কারিগরি একে বিশেষত্ব দিয়েছে। তবে এর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে আরেকটি গল্প।
ধারণা করা হয়, এটি উনিশ শতকে চীনের গুয়াংসু সম্রাটের এক উপপত্নীর যৌতুকের অংশ ছিল। সেই সূত্রে বাঁধাকপিটি নারীর পবিত্রতা এবং পঙ্গপাল ও ফড়িং প্রাচুর্য ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায়। যদিও ইতিহাসবিদেরা এই তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু এই গল্পই সাধারণ মানুষের কল্পনাকে আকৃষ্ট করেছে।
জাদুঘরের 'তিন অমূল্য ধন'-এর একটি হিসেবে এটিকে প্রায়ই প্রচার করা হয়। বাকি দুটি হলো 'মাংসের মতো দেখতে পাথর' এবং প্রাচীন ব্রোঞ্জের পাত্র 'মাও কুং টিং'। পর্যটকদের কাছে এই তিনটিকে রসিকতা করে 'আচারি বাঁধাকপি দিয়ে শুকরের মাংসের হটপট' বলেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পবোদ্ধাদের মতে, চিং রাজবংশের জেড খোদাই শিল্পের এটি একটি উদাহরণ হলেও একমাত্র নয়। জাদুঘরের কিউরেটরদের জন্য এর খ্যাতি একধরনের বিড়ম্বনাও বটে।
জাদুঘরের সাবেক গবেষক ওয়াং শাও-চুন সিএনএনকে বলেন, 'এর জনপ্রিয়তা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের মধ্যে একটি স্পষ্ট অমিল রয়েছে। আমরা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোকেও তুলে ধরতে চাই, কিন্তু বহু দর্শকের মাথায় কেবল ওই বাঁধাকপির কথাই ঘোরে।'
সম্ভবত একারণেই তাইওয়ানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একে পূর্ণাঙ্গ 'জাতীয় সম্পদ' না বলে 'গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন নিদর্শন' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
চলতি বছর জাদুঘরের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে 'জেড বাঁধাকপি'-সহ ১৩০টির বেশি নিদর্শন চেক প্রজাতন্ত্রে একটি প্রদর্শনীতে পাঠানো হয়েছে।
বেইজিং তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ দাবি করে, যদিও ইতিহাসে দেশটি কখনো তাদের শাসনের অধীনে ছিল না; চেক প্রজাতন্ত্রে প্রদর্শনী আয়োজনকে কেন্দ্র করে তাইপেইকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত' হিসেবে সমালোচনা করেছে।
এর জবাবে তাইওয়ানের সরকার ও ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়ামের কর্মকর্তারা অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছেন, এটি কেবল একটি 'সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি'।
এর মধ্যেই গত সেপ্টেম্বরে তাইওয়ান সরকার একটি বেনামি ইমেইল পাওয়ার কথা জানায়, যেখানে প্রদর্শনী চালু থাকলে অগ্নিসংযোগ, চুরি, গুলি বা সন্ত্রাসী হামলার হুমকি দেওয়া হয়। তবে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রদর্শনীটি এখনো চলছে এবং সেখানেও জেডাইট বাঁধাকপি দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাচ্ছে।
