বিশ্লেষণ: শুধু ট্রাম্প নয়, আরও যেসব কারণে বিবিসির শীর্ষ দুই কর্মকর্তার পদত্যাগ
বিদায়ী বিবিসি মহাপরিচালক টিম ডেভির এক বক্তব্যের একটি শব্দই ব্যাখ্যা করে দিয়েছে শুধু তাঁর পদত্যাগ নয়, বরং ২০২৫ সালের মিডিয়া নেতৃত্বের রাজনৈতিক বাস্তবতাও। শব্দটি হলো—"ফিব্রাইল"।
ডিকশনারি.কম অনুযায়ী, "ফিব্রাইল" মানে হচ্ছে "জ্বরে আক্রান্ত" বা "জ্বরতপ্ত"—আর রূপক অর্থে বলতে গেলে, তীব্র উত্তেজনা বা অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিবিসি ঘিরে বিতর্ক নিঃসন্দেহে এমন এক জ্বরতপ্ত পরিবেশে পৌঁছেছে। তবে এই ধরনের তর্ক-বিতর্ক বিবিসিকে ঘিরে নতুন কিছু নয়—ব্রিটিশ সমাজে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমটির বিরাট প্রভাব ও অনন্য অবস্থানের কারণেই এটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
ফলে বিবিসির মহাপরিচালকের পদ যতই মর্যাদাপূর্ণ হোক, ততটাই অবিরাম চাপ ও কৃতজ্ঞতাহীন দায়িত্ব এটি। সম্প্রতি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ২০২৪ সালের এক প্রামাণ্যচিত্রে বিভ্রান্তিকর সম্পাদনা নিয়ে তৈরি বিতর্ক এই বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এক বছরেরও বেশি পুরোনো সেই ভুল সম্পাদনা হয়তো বিবিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ ডেকে আনত না।
কিন্তু বিবিসির এক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের ডানপন্থী গণমাধ্যমগুলো "শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে" এই ঘটনাকে ঘিরে। বিপরীতে সংস্থাটির প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল, যা রক্ষণশীল সমালোচকদের দীর্ঘদিনের বিবিসি-বিরোধী প্রচারণাকে আরও জোরদার করার সুযোগ দেয়।
ট্রাম্প রোববার এই পদত্যাগকে নিজের জন্য "একটি বিজয়" হিসেবে উদযাপন করেন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রামাণ্যচিত্র-সংক্রান্ত বিতর্কটি ছিল অসংখ্য কারণের মধ্যে মাত্র একটি।
ইসরায়েলের গাজা অভিযানের বিবিসি কাভারেজ নিয়ে বিতর্ক, প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত আক্রমণ, এবং বিবিসির লাইসেন্স ফি কাঠামো পুনর্বিবেচনা নিয়ে সরকারের আসন্ন পর্যালোচনা—এই জটিল পরিস্থিতিতে ডেভি ও বিবিসি নিউজের বার্তাপ্রধান ডেবোরা টারনেসের পদত্যাগ অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল। তাঁদের বিদায়ী নোটে সেই "স্বস্তির নিঃশ্বাস" স্পষ্ট ছিল।
ডেভি লিখেছেন, "সামগ্রিকভাবে বিবিসি ভালো কাজ করছে, তবে কিছু ভুল হয়েছে, আর মহাপরিচালক হিসেবে চূড়ান্ত দায়িত্ব আমারই।" টারনেসও প্রায় একইভাবে লিখেছেন—"ভুল হয়েছে, এবং আমরা তা স্বীকার করছি।"
বিবিসি রেডিও ৪–এর উপস্থাপক ও সাবেক রাজনৈতিক সম্পাদক নিক রবিনসন পদত্যাগের আগের দিন বলেন, "সত্যিই সম্পাদকীয় মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে এবং ভুলও হয়েছে। একইসঙ্গে, এমন এক রাজনৈতিক প্রচারণা চলছে যারা বিবিসিকে ধ্বংস করতে চায়। দুই ঘটনাই একসঙ্গে ঘটছে।"
এই "দুই বাস্তবতার সংঘাতই" সেই 'ফিব্রাইল' পরিবেশের মূল, যেটির কথা ডেভি উল্লেখ করেছিলেন।
ডেভি বলেছেন, বিবিসি বোর্ড তাঁর পুরো মেয়াদ জুড়েই, সাম্প্রতিক সময়সহ, সর্বসম্মত সমর্থন দিয়েছে, অর্থাৎ তাঁকে জোর করে সরানো হয়নি। তিনি আরও বলেন, "বিবিসি নিউজকে ঘিরে চলমান বিতর্ক ছিল পদত্যাগের কেবল একটি কারণ।"
আরেকটি বড় কারণ হলো—সরকার বর্তমানে বিবিসির রয়্যাল চার্টার পুনর্মূল্যায়ন করছে, যা সংস্থার অর্থায়ন ও কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করে। ২০২৭ সালে মেয়াদ শেষ হবে বর্তমান চার্টারের, যার আওতায় যুক্তরাজ্যের প্রত্যেক পরিবার বছরে ১৭৪.৫০ পাউন্ড ( বা প্রায় ২৩২ ডলার) ফি দেয় বিবিসির সেবা গ্রহণের জন্য। এই কাঠামো বহু দশক ধরে বিবিসির বৈচিত্র্যময় প্রোগ্রাম টিকিয়ে রেখেছে, তবে এর সমালোচনাও কম নয়।
অনেক রক্ষণশীল নেতা মনে করেন, নেটফ্লিক্স ও স্পটিফাইয়ের যুগে এই লাইসেন্স ফি পদ্ধতি সেকেলে, এবং তারা প্রায়ই বিবিসির তথাকথিত রাজনৈতিক পক্ষপাত নিয়ে অভিযোগ তোলেন।
ডেভি বলেন, "এই অত্যন্ত অস্থির সময়ে বহু বছর ধরে এ পদে কাজ করার ব্যক্তিগত ও পেশাগত চাপ নিয়ে আমি গভীরভাবে ভাবছিলাম। আমি চাই আমার উত্তরসূরির হাতে যথেষ্ট সময় থাকুক, যাতে তিনি আসন্ন চার্টার সংস্কারে ভূমিকা রাখতে পারেন।"
রাজনীতিতে ঘেরা মিডিয়া পরিবেশে বিবিসির টিকে থাকা কঠিন হচ্ছে
২০২০ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ডেভি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর প্রধান লক্ষ্য হবে বিবিসির "নিরপেক্ষতার প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনরুদ্ধার" করা।
আজকের প্রায় সব বিতর্কই সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত।
এই বছরের শুরুতে বিবিসি "গাজা: হাউ টু সারভাইভ অ্যা ওয়ারজোন" নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র তাদের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে নেয়—কারণ জানা যায়, এর কথক ছিলেন এক হামাস কর্মকর্তার ছেলে, যা বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালার পরিপন্থী। পর্যালোচনার পর ডেভি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান।
বিবিসি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, যুদ্ধ সম্পর্কিত তাদের প্রতিবেদনে অসাধারণ পরিশ্রম ও ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে। তারা জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে পুরো কভারেজের সামগ্রিক চিত্র দেখতে—সুদানের গৃহযুদ্ধ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে শুরু করে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক ফিচার পর্যন্ত।
তবে এসব প্রচেষ্টা প্রায়ই হারিয়ে যায়, যখন কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে টার্গেট করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিডিয়া ঝড় তৈরি করা হয়।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট শনিবার দ্য টেলিগ্রাফ–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে আখ্যা দেন "প্রচণ্ড পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারযন্ত্র" ও "শতভাগ ভুয়া সংবাদমাধ্যম" হিসেবে—যা ডেভি ও টারনেসের বিরুদ্ধে আরও আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
এই ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল "ট্রাম্প: অ্যা সেকেন্ড চান্স?" শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্র। সেখানে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের কিছু অংশ এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়, যেন মনে হয় তিনি সরাসরি তাদের সঙ্গে ক্যাপিটলে যেতে ও "লড়াই" করতে বলেছিলেন। আসল ভাষণে দুইটি বক্তব্য সম্পূর্ণ আলাদা ছিল—একটি ক্যাপিটলে যাওয়ার আহ্বান, আর অন্যটি সংগ্রামের রূপক আহ্বান।
প্রামাণ্যচিত্রটি বিবিসির বিখ্যাত প্যানারোমা অনুষ্ঠানে ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচন শুরুর ঠিক আগে প্রচারিত হয়, এবং পরে বিবিসির সম্পাদকীয় মানদণ্ড কমিটির সাবেক উপদেষ্টা মাইকেল প্রেসকট এ নিয়ে এক অভ্যন্তরীণ মেমোতে মন্তব্য করেন।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া: "আমার নিখুঁত বক্তৃতা বিকৃত করেছে বিবিসি"
দ্য টেলিগ্রাফ, যা বহু বছর ধরে বিবিসি-বিরোধী মন্তব্য প্রকাশ করে আসছে, ৩ নভেম্বর মেমোটির তথ্য প্রকাশ করে। এরপর থেকেই যুক্তরাজ্যে বিবিসি ঘিরে টানা বিতর্ক শুরু হয়।
প্রতিদিনের ফলোআপ প্রতিবেদনে টেলিগ্রাফ এই ঘটনাকে "করপোরেশনের ক্রমবর্ধমান সংকট" হিসেবে তুলে ধরে এবং সমালোচকদের বক্তব্য প্রচার করে, যার মধ্যে লেভিটের সাক্ষাৎকারও ছিল। প্রামাণ্যচিত্রটির প্রযোজনা সংস্থা—একটি বাইরের প্রোডাকশন কোম্পানি—এখনো নীরব রয়েছে।
রোববার ট্রাম্প ও তাঁর সহকারীরা এই পদত্যাগকে নিজেদের বিজয় হিসেবে উদযাপন করেন। ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল–এ লেখেন, "বিবিসি কর্মকর্তারা আমার অত্যন্ত ভালো (পারফেক্ট!) বক্তৃতা বিকৃত করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।"
যদিও কোনো প্রমাণ নেই যে ডেভি বা টারনেস প্রামাণ্যচিত্রটির সম্পাদনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন।
ট্রাম্প আরও লেখেন, "দ্য টেলিগ্রাফ-কে ধন্যবাদ এই দুর্নীতিগ্রস্ত সাংবাদিকদের উন্মোচন করার জন্য। তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভারসাম্য নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল।"
প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে সম্পাদনাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তাছাড়া, প্রামাণ্যচিত্রটির মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাজ্যের দর্শক, মার্কিন নয়।
এদিকে প্রেস সেক্রেটারি লেভিট সুযোগটি কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্যের ডানপন্থী চ্যানেল জিবি নিউজ–এর প্রশংসা করেন, এই গণমাধ্যমটিকে প্রায়ই "ব্রিটিশ ফক্স নিউজ" বলা হয়।
সব মিলিয়ে, টিম ডেভির ব্যবহৃত শব্দটি হয়তো এখনকার ব্রিটিশ সংবাদ জগতের জন্য সবচেয়ে যথাযথ—একটি সত্যিকার অর্থে "ফিব্রাইল" বা জ্বরতপ্ত মিডিয়া পরিবেশ।
