লড়াই চালিয়ে যাবে নাকি পিছু হটে সৈন্য বাঁচাবে: পোকরোভস্ক নিয়ে উভয়সংকটে ইউক্রেন
পূর্ব ইউক্রেনের অবরুদ্ধ শহর পোকরোভস্কে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে মরিয়া হয়ে লড়ছে ইউক্রেনীয় সেনারা। কিন্তু শহরটিতে টিকে থাকার লড়াই যত তীব্র হচ্ছে, ততই জোরালো হচ্ছে এক কঠিন প্রশ্ন—তাদের কি কৌশলগতভাবে পিছু হটা উচিত? এমন সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো অনেক সেনার জীবন বাঁচবে, কিন্তু তা রাশিয়ার হাতে তুলে দেবে এক বিরাট প্রচারণামূলক বিজয়।
গত দুই বছর ধরে রুশ অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রেখেছে ইউক্রেন। কিন্তু এখন যখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছেন কিয়েভকে দোনেৎস্ক অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার একটি চুক্তিতে রাজি করাতে, তখন ইউক্রেন আরও বেশি অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছে কোনো ভূখণ্ড ছাড়তে।
পোকরোভস্ক ছেড়ে দেয়া হয়ত ইউক্রেনের জন্য সামরিকভাবে লাভজনক হতে পারে। কিন্তু এতে রুশ মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং ওয়াশিংটনের কাছে এটি এমন বার্তা দিতে পারে যে ইউক্রেন মস্কোর আগ্রাসন ঠেকাতে পারছে না। অন্যদিকে, শহরের ভেতরেই যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সৈন্য ও সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে—যেখানে দেশটি ইতিমধ্যে জনবল সংকটে ভুগছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক মাইকোলা বিলিয়েস্কভ বলেন, পোকরোভস্ক হারালে পুতিন 'প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোঝাতে চাইবেন যে রাশিয়ার বিজয় অনিবার্য এবং ইউক্রেনকে সহায়তা করা অর্থহীন।'
তিনি বলেন, 'কিয়েভের সামনে এখন কঠিন এক সিদ্ধান্ত। একদিকে সৈন্যদের বাঁচানো জরুরি, অন্যদিকে সার্বভৌম ভূখণ্ড থেকে সরে যাওয়া রাজনৈতিকভাবে খুবই স্পর্শকাতর—যা রাশিয়ার জন্য কূটনৈতিক সুবিধা এনে দেবে।'
রুশ বাহিনী যদি পোকরোভস্ক পুরোপুরি দখল করে নেয়, তবে তাদের জন্য পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের দিনিপ্রোপেত্রোভস্ক ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের পথে অগ্রসর হওয়ার নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
এই দোটানার পেছনে আগের অভিজ্ঞতাও কাজ করছে। ২০২৩ সালে বাখমুত ও ২০২৪ সালে আভদিভকা শহরে ইউক্রেন শেষ পর্যন্ত অবস্থান ধরে রেখে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। বিপরীতে, জনসংখ্যার দিক থেকে অনেক বড় রাশিয়া সহজেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়।
ইউক্রেনের সমালোচকেরা তখন বলেছিলেন, আগেভাগে সরে গেলে হয়তো বহু প্রাণ রক্ষা পেত।
যদি পোকরোভস্ক পতন ঘটে, তবে বাখমুতের পর এটিই হবে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দখলকৃত শহর।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আন্দ্রি রিজেনকো বলেন, রাশিয়া এখন পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের যত বেশি এলাকা সম্ভব দখল করতে চায়, যাতে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার চাপ সৃষ্টি হয় এবং আলোচনায় রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যায়।
এদিকে, সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। মার্কিনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানিয়েছে, রুশ বাহিনী এখন পোকরোভস্কের ভেতরে 'আরও স্বাচ্ছন্দ্যে' অভিযান চালাচ্ছে এবং দক্ষিণের মিরনোহ্রাদ শহরেও অগ্রসর হয়েছে।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে শহরের ভেতর পরিস্থিতি কঠিন। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, সেখানে রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয় সৈন্যদের তুলনায় আটগুণ বেশি। তবে তিনি দাবি করেছেন, রুশ সেনারা শহর ঘিরে ফেলেছে—এমন খবর 'ভিত্তিহীন', এবং সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মস্কো 'কোনো বড় সাফল্য' পায়নি।
জেলেনস্কি বলেন, 'আপনারা বুঝতে পারছেন, আমাদের ছেলেদের জন্য এটা সহজ নয়।'
সামরিক বিশ্লেষক এমিল কাস্তেহেলমি মনে করেন, যদি ইউক্রেন এখন পোকরোভস্ক থেকে সরে গিয়ে আশপাশে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করতে পারে, তবে তা কৌশলগতভাবে লাভজনক হবে। এতে ফ্রন্টলাইন ছোট হবে এবং রসদ সরবরাহ সহজ হবে।
'এক বছর যুদ্ধের পর এই শহরগুলো হারানো বড় কৌশলগত পরিবর্তন আনবে না,' তিনি বলেন। 'এখন সৈন্যদের জীবনই সবচেয়ে মূল্যবান—ভূখণ্ড নয়।'
কার্নেগি এনডাউমেন্টের মাইকেল কফম্যান বলেন, 'এই মুহূর্তে ইউক্রেনীয় বাহিনীর উচিত পিছু হটা, কারণ তারা এক ধরনের ভেঙে পড়া ঘেরাটোপে আছে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, এখন পরিস্থিতি 'অত্যন্ত বিপজ্জনক', এবং কতজন ইউক্রেনীয় সৈন্য শহরে রয়ে গেছেন তা কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না। 'শত্রু ড্রোনের আগুনের নিচে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া এখন অত্যন্ত কঠিন।'
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (জিইউআর) জানিয়েছে, গত কয়েক দিনে তারা পোকরোভস্কে চাপ কমাতে ও রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেশ কিছু অভিযান চালিয়েছে।
কেন্দার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির বিশ্লেষক ফ্রানৎস-স্টেফান গ্যাডি বলেন, 'ফ্রন্টলাইন স্থিতিশীল না হলে বা শহর থেকে রুশ সেনাদের তাড়ানো না গেলে এই ঘেরাটোপ খুব শিগগিরই ভেঙে পড়তে পারে।'
তিনি বলেন, এখন কিয়েভের সামনে দুটি প্রশ্ন—তারা কি ভারী ক্ষতি ছাড়া সৈন্যদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে পারবে, এবং শহরের উত্তরে নতুন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করতে পারবে কি না।
রুশ বিমান ও ড্রোনের আধিপত্যের কারণে ইউক্রেনীয় বাহিনী হয়তো 'বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসের অপেক্ষায়' থাকতে হবে, যাতে রুশ ড্রোন অভিযান ব্যাহত হয় এবং সরে যাওয়ার সময় লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ঝুঁকি কমে।
আইএসডব্লিউ জানিয়েছে, রুশ বাহিনী সম্প্রতি ইউক্রেনের ড্রোন ইউনিটগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে, যাতে আকাশে তাদের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয় এবং শহরে প্রবেশ সহজ হয়।
যদিও পোকরোভস্ক হারানো কিয়েভের জন্য ধাক্কা হবে, তবে যুদ্ধের সামগ্রিক চিত্রে এটি 'গেম চেঞ্জার' নয়।
কফম্যান বলেন, 'এই শহর দখল করলে রাশিয়া দোনেৎস্ক অঞ্চলের বাকি অংশ ঘিরে ধরার সুযোগ পাবে, তবে এতে ইউক্রেনের সার্বিক প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়বে না।'
'শেষ পর্যন্ত, পোকরোভস্ক কেবল একটি ফ্রন্টলাইন,' তিনি বলেন। 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—ইউক্রেন যেন সৈন্যদের রক্ষা করতে পারে এবং চারদিকে ঘেরাও এড়াতে পারে।'
