৫০ হাজার কোটি ডলারের মালিক ইলন মাস্ক; এত টাকা দিয়ে কী করেন তিনি?
বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হিসেবে টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের নাম বহু বছর ধরেই পরিচিত। সম্প্রতি তার সম্পদের পরিমাণ এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, তাকে বিশ্বের প্রথম 'হাফ ট্রিলিয়নেয়ার' বা ৫০ হাজার কোটি ডলারের মালিক হিসেবেও অভিহিত করা হচ্ছে।
কিন্তু এত বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মাস্কের দাবি, তার জীবনযাপন একদমই বিলাসবহুল নয়। বরং তিনি নাকি বেশ 'সাদামাটা' জীবনযাপন করেন।
২০২১ সালে ইলন মাস্ক জানিয়েছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে মাত্র ৫০ হাজার ডলার মূল্যের একটি ছোট বাড়িতে থাকেন। ২০২২ সালে ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার সাবেক সঙ্গী গ্রাইমস মাস্কের জীবনযাপন সম্পর্কে বলেন, 'মাস্ক বাস্তবে এতোটাও বিলাসিতার জীবন কাটান না, মাঝে মাঝে তো দরিদ্রসীমার নিচেও থাকেন।'
গ্রাইমস আরও জানান, একবার মাস্কের ব্যবহৃত গদির একপাশে বিশাল গর্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা-ও নাকি তিনি নতুন গদি কিনতে রাজি হননি।
মাস্ক জানান, তার নামে এখন কোনো বাড়িও নেই। টেড-এর প্রধান ক্রিস অ্যান্ডারসনকে তিনি বলেন, 'আমি আসলে আমার বন্ধুদের বাড়িতেই থাকি। যখন বে এরিয়ায় যাই—যেখানে টেসলার ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের বেশিরভাগ কাজ হয়—তখন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ির ফাঁকা রুমে পালা করে থাকি।'
এটি নতুন কোনো তথ্য নয়। ২০১৫ সালে সাবেক গুগল প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজ লেখক অ্যাশলি ভ্যান্সকে বলেছিলেন, 'মাস্ক কিছুটা যাযাবর ধরণের। মাঝেমাঝে সে ইমেইল করে বলে, আজ রাতে কোথায় থাকব জানি না, তোমার বাড়িতে আসতে পারি?'
মাস্কের র 'প্রধান বাসস্থান' হলো টেক্সাসের দক্ষিণ প্রান্তে স্পেসএক্সের কার্যক্রমের কাছাকাছি প্রায় ৫০ হাজার ডলারে কেনা একটি সাধারণ প্রিফ্যাব্রিকেটেড বাড়ি। এলাকাটির নাম এখন 'স্টারবেস'।
যদিও সাধারণ জীবনযাপনের দাবি করলেও ইলন মাস্কের ব্যতিক্রমী কিছু শখ রয়েছে, যা তার বিপুল সম্পদের সঙ্গে দারুণভাবে মানানসই। রিয়েল এস্টেট বা ব্যক্তিগত বাসস্থানে তিনি যতই অনাগ্রহী হন না কেন, গাড়ির ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই ব্যতিক্রম।
টেসলার মালিক হিসেবে তার রয়েছে অসাধারণ কিছু গাড়ির সংগ্রহ। এর মধ্যে বিখ্যাত ফোর্ড মডেল টি থেকে শুরু করে রয়েছে ১৯৬৭ সালের জাগুয়ার ই-টাইপ রোডস্টার—শৈশব থেকেই যার প্রতি তার বিশেষ টান ছিল। এছাড়া ১৯৯৭ সালের ম্যাকলারেন এফ১ গাড়িটিও তার সংগ্রহে ছিল, যা তিনি একবার এক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বিক্রি করে দেন।
মাস্কের সবচেয়ে আলোচিত গাড়িগুলোর মধ্যে একটি হলো টেসলা রোডস্টার। ২০১৮ সালে তিনি সেই গাড়িটিই মহাকাশে পাঠিয়ে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেন। তবে তার সংগ্রহের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী গাড়িটি হলো ১৯৭৬ সালের লোটাস এসপ্রিট।
১৯৭৭ সালের জেমস বন্ডের সিনেমা 'দ্য স্পাই হু লাভড মি'-তে ব্যবহৃত হয়েছিল এই গাড়িটি, যা সিনেমায় 'ওয়েট নেলি' নামে পানির নিচে সাবমেরিনে রূপ নিতে পারত। ২০১৩ সালে মাস্ক প্রায় ১০ লাখ ডলার ব্যয় করে নিলামে গাড়িটি কেনেন, উদ্দেশ্য ছিল আবারও সেটিকে বাস্তবে সাবমেরিনে রূপান্তর করা।
গাড়ির পাশাপাশি বিমানও মাস্কের আরেকটি প্রিয় বিলাসিতা। যদিও তার দাবি, এটি মূলত কাজের প্রয়োজনে। ২০২২ সালে টেড-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি যদি প্লেন ব্যবহার না করি, তাহলে কাজের সময় অনেক কমে যাবে।'
তার মালিকানায় রয়েছে একাধিক গালফস্ট্রিম মডেলের প্রাইভেট জেট, প্রতিটির মূল্য কয়েক কোটি ডলার।
একসময় রিয়েল এস্টেট জগতেও ইলন মাস্কের ছিল চমকপ্রদ এক সাম্রাজ্য। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সাল নাগাদ ক্যালিফোর্নিয়ার মর্যাদাপূর্ণ বেল-এয়ার এলাকায় প্রায় সাত বছরে তিনি সাতটি বাড়ি কিনতে প্রায় ১০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন।
এই প্রাসাদগুলোতে ছিল সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, ওয়াইন সেলার, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি এবং বলরুমের মতো বিলাসবহুল সুবিধা। এর মধ্যে একটি ছিল কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের মালিকানাধীন র্যাঞ্চ হাউস।
তবে ২০২০ সালে মাস্ক হঠাৎ মত পরিবর্তন করেন। টুইটারে ঘোষণা দেন, তিনি 'প্রায় সব ভৌত সম্পত্তি বিক্রি করে দেবেন' এবং 'নিজের নামে কোনো বাড়িও রাখবেন না'।
ওয়াইল্ডারের বাড়িটি তিনি তার ভাতিজা জর্ডান ওয়াকার-পার্লম্যানের কাছে বিক্রি করেন, এমনকি কেনার জন্য তাকে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঋণও দেন। তবে ২০২৫ সালের জুনে কিস্তি বাকি পড়ে যাওয়ায় মাস্ক পুনরায় বাড়িটির মালিকানা ফিরে পান।
আর বিলাসিতার ব্যতিক্রম ঘটেছিল ২০২২ সালে, যখন তিনি প্রায় ৪৪০০ কোটি ডলারে কিনে নিয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার।
ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নথি অনুযায়ী বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় বিলিয়ন ডলারের শেয়ার অনুদান দিয়েছেন এবং নানা খাতে কোটি কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তবে এটি নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস গত বছর এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, মাস্কের দাতব্য কার্যক্রম 'খুবই বিচ্ছিন্ন ও অনেকাংশে নিজস্ব স্বার্থে পরিচালিত', যা তাকে বিশাল করছাড়ের সুযোগ করে দেয় এবং তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করে।
মাস্কের দাতব্য সংস্থা 'দ্য মাস্ক ফাউন্ডেশন'-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি 'বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং মানব অগ্রগতির জন্য উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানবতার উন্নয়নে নিবেদিত'। তবে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, সংস্থাটি টানা তিন বছর প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ অনুদান দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দানের একটি বড় অংশ গেছে মাস্কের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
২০২২ সালে মাস্ক বলেন, 'আপনি যদি বাস্তবতা নিয়ে ভাবেন, দাতব্য কাজ আসলে খুব কঠিন।'
মাস্কের মতে, তার ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোই এক ধরনের মানবসেবামূলক কাজ। তিনি বলেন, টেসলা 'টেকসই জ্বালানি ব্যবহারে বিশ্বকে ত্বরান্বিত করছে', স্পেসএক্স 'মানব জাতির দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকার নিশ্চয়তা দিতে কাজ করছে', আর নিউরালিঙ্ক 'মস্তিষ্কের আঘাত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করছে'।
