‘কিছু একটা ঘটুক—এই অপেক্ষা!’ ভয়ংকর সব ভ্রমণের জন্য কেন মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেন এই পর্যটকেরা
অ্যাশলি ওয়াইজম্যান, পেশায় একজন নার্স, ভূতের সন্ধানে গত ছয় বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু জর্জিয়ার সাভানার এক পুরনো বাড়িতে গিয়ে তিনি ভয়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন।
২০১৮ সালের ঘটনা। ৪১ বছর বয়সী অ্যাশলি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের বাসিন্দা। তিনি একটি ঘোস্ট-হান্টিং বা ভূতের সন্ধানী দলের সাথে ওই বাড়িতে যান। বাড়িটি একসময় মুন রিভার ব্রিউইং কোম্পানির অধীনে ছিল। প্রথম থেকেই তার অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু যখন তিনি দোতলায় পৌঁছান, তখন শোনেন, তার পেছনেই কেউ যেন হেঁটে আসছে, অথচ সেখানে কেউ ছিল না। তিনি একঝলক 'এক কুৎসিত, প্রাচীন চেহারার বৃদ্ধা মহিলাকে' দেখার কথাও মনে করেন।
যখন তিনি ঘরের কোণায় আরেকটি ছায়ামূর্তি দেখতে পান, তখন বুঝতে পারেন, "কিছু একটা ঘটতে চলেছে"। এর পরপরই অ্যাশলি দেখেন, এক অন্ধকার দানবাকৃতির বস্তু যেন অন্যদের ক্ষতি করার জন্যই দরজা দিয়ে ছুটে আসছে।
১৩ বছরের অভিজ্ঞ এই নার্স বলেন, "আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী, কিন্তু ওই ঘটনায় আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে পরে কেঁদে ফেলেছিলাম।" এত ভয় পাওয়ার পরেও অ্যাশলি তার এই অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক ভ্রমণ থামাননি। ২০১২ সাল থেকে ভূতের পেছনে প্রায় ৮০টি ট্রিপে তিনি এক লক্ষ ডলারেরও বেশি (প্রায় এক কোটি টাকার বেশি) খরচ করেছেন।
অ্যাশলি একা নন। তার মতো আরও অনেকেই আছেন, যারা এই ধরনের অভিজ্ঞতা ভালোবাসেন। তাদের বলা হয় 'প্যারানরমাল ট্যুরিস্ট'। কোনো শহরে গিয়ে দুই ঘণ্টার ভূতের গল্প শুনেই তারা সন্তুষ্ট হন না, বরং পুরো ছুটিটাই পরিকল্পনা করেন এমন সব জায়গায় যাওয়ার জন্য, যেখানে অলৌকিক কিছুর মুখোমুখি হওয়া যায়। আর এর জন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতেও রাজি।
কেন এই আকর্ষণ?
২০০০ সালের পর থেকে টেলিভিশনে প্যারানরমাল বা অলৌকিক ঘটনা নিয়ে রিয়েলিটি শো এবং ইউটিউব চ্যানেল জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে ভূতের ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। এই জায়গাগুলো যে শুধু মাকড়সার জালে ঢাকা নির্জন ভাঙা বাড়ি, তা নয়। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দর সব হোটেল, যেমন কলোরাডোর দ্য স্ট্যানলি হোটেল (যেটি স্টিফেন কিং-এর বিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য শাইনিং'-এর অনুপ্রেরণা) অথবা মেরিল্যান্ডের দ্য লর্ড বাল্টিমোর হোটেল, যেখানে মহামন্দার সময় অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং বলা হয় 'মলি' নামের এক ছোট্ট মেয়ের ভূত সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
এই পর্যটকদের কাছে এমন ভ্রমণের অনেক আকর্ষণ রয়েছে। কেউ হয়তো 'অন্য জগতের' সাথে যোগাযোগ করতে চান, কেউ বা নিজের মতো ভাবনার মানুষের সাথে মিশতে চান, আবার কেউ নিছকই ভয় পাওয়ার রোমাঞ্চ উপভোগ করতে চান।
অ্যাশলি বলেন, "এটা আমার রোমাঞ্চ খোঁজার স্বভাব। আমি বিমান থেকে লাফ দেব না বা পাহাড় থেকে স্কি করব না, কিন্তু আমি অলৌকিক ঘটনার তদন্ত করব; এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা দেয়।"
তিনি আরও বলেন, "ভাবুন, আপনি বন্ধুদের সাথে অন্ধকারে বসে আছেন, কিছুই হচ্ছে না, হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠল, বা এমন কোনো ফিসফিসানি শুনলেন যা সেখানে শোনার কথা নয়। আপনার হৃৎপিণ্ড বাড়তে শুরু করে, আর আপনি অপেক্ষা করতে থাকেন কিছু একটার জন্য—আপনি চান, যেন কিছু একটা ঘটে।"
'অবাক, আতঙ্কিত, ভীত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়'
ডেভিড এবং অ্যালিসিয়া লিওনহার্ট, মিনেসোটার দুই হিসাবরক্ষক, ২০১৩ সাল থেকে ৩০টিরও বেশি ভৌতিক জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। তারা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে গাড়ি চালিয়ে যান এবং ভ্রমণের পাশাপাশি অলৌকিক ঘটনা তদন্তের সরঞ্জামের পেছনে বছরে প্রায় ৫,০০০ ডলার খরচ করেন।
পল রবার্টস নামে আরেকজন পর্যটক লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি থিয়েটারে নয়বার ভূতের সন্ধানে গিয়েছেন। তবে নেভাদার গোল্ড হিল হোটেলে তার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ঙ্কর। যে কেবিনে তিনি ছিলেন, তার পাশেই একটি খনির মুখ ছিল, যেখানে ১৮৬৯ সালে আগুনে পুড়ে অন্তত ৩৫ জন মারা যায়। রবার্টস বলেন, সেই রাতে তাকে অদৃশ্য শক্তি শারীরিকভাবে আক্রমণ করে।
এই অভিজ্ঞতা তাকে "অবাক, আতঙ্কিত, ভীত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়" করে দিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পরেও তিনি বলেন, "আমি খুশি যে এটা ঘটেছিল।"
পল এই ধরনের ভ্রমণে ২৫,০০০ ডলারেরও বেশি খরচ করেছেন। তার মতে, "আমি এই অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসি, অন্য জগতের শক্তির সাথে যোগাযোগের রোমাঞ্চ এবং এই নিশ্চিতকরণ যে আমাদের চারপাশে অন্য মাত্রার অস্তিত্ব রয়েছে।"
ভয়ের পেছনের বিজ্ঞান
সমাজবিজ্ঞানী মার্জি কেরের মতে, মানুষ কেন এমন ভয়ঙ্কর অ্যাডভেঞ্চারের দিকে ঝোঁকে, তার পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, এখানে ভয় এবং উত্তেজনার এক অদ্ভুত মিশ্রণ কাজ করে, যা আমাদের শরীরের "ফাইট অর ফ্লাইট" (যুদ্ধ করো অথবা পালাও) প্রতিক্রিয়াকে জাগিয়ে তোলে। এটি অনেকটা ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার মতো। আমরা যেমন লুকানোর সময় ধরা পড়ার ভয়ে উত্তেজিত থাকতাম, এখানেও তেমনই এক অজানা আবিষ্কারের উত্তেজনা কাজ করে।
কের যোগ করেন, "ভয় আর মজার এই মেলবন্ধনটাই আসল।" হ্যালোউইনে ভুতুড়ে সাজগোজ থেকে শুরু করে ভূতের গল্প শোনা এবং সবশেষে ভূতের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া—সবই এই রোমাঞ্চের অংশ।
কৌতূহল এবং একাত্মবোধ
ফ্লোরিডার 'হন্টেড কি ওয়েস্ট' নামে একটি ট্যুর কোম্পানির মালিক ডেভিড এল স্লোন বলেন, "আমার মনে হয়, মানুষ জানতে চায় মৃত্যুর পর কী হয়। আমাদের সবার মধ্যেই পরকাল নিয়ে কৌতূহল আছে, আর এই ভ্রমণগুলো তাদের সেই জগৎটা ঘুরে দেখার সুযোগ করে দেয়।"
মিশিগানের বাসিন্দা নিকোল বোচ্যাম্প বলেন, তার এই আগ্রহ শুরু হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। তার বাবা-মাও একই বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং তাকে উৎসাহিত করতেন। তিনি এখন পর্যন্ত এই ধরনের ভ্রমণে প্রায় এক লক্ষ ডলার খরচ করেছেন।
নিকোল বলেন, "এটা একটা বড় আর্থিক বিনিয়োগ, কিন্তু আমি সবসময়ই একে সার্থক মনে করেছি, কারণ এর মাধ্যমে আমি যে অভিজ্ঞতা, ইতিহাস এবং একাত্মবোধ পাই, তা অমূল্য।"
আসলেই, এই ভ্রমণের একটি বড় অংশ হলো নিজের মতো ভাবনার মানুষ খুঁজে পাওয়া, যেখানে তারা নিজেদের গল্প এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারে। টিভি ব্যক্তিত্ব এবং 'স্ট্রেঞ্জ এস্কেপস' প্যারানরমাল ট্যুরিজম কোম্পানির মালিক অ্যামি ব্রুনি বলেন, "ভূতের সন্ধানে মানুষ এখানে আসে, কিন্তু এসে তারা বুঝতে পারে যে এখানে একটা আস্ত কমিউনিটি আছে, যেখানে তারা অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে মন খুলে কথা বলতে পারে।"
তবুও, একটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা পর্যটকদের বারবার ফিরিয়ে আনে। যেমনটা লিওনহার্ট আইওয়ার স্কুলে "দ্য প্রিন্সিপাল" নামের সেই ছায়ামূর্তির মুখোমুখি হওয়ার কথা ভাবছিলেন।
তিনি বলেন, "যখন আমি দরজার কাঁপুনি শুনলাম এবং অনুভব করলাম, আমি ঠিক তার পাশেই বসেছিলাম। প্রিন্সিপালের কুখ্যাতির কথা ভেবে আমার মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। যদি ওটা দরজাকে নাড়াতে পারে, তবে আমার সাথে কী করতে পারে?"
এই ধরনের হাড়হিম করা প্রশ্ন এবং অজানা জগতের প্রতি তীব্র আকর্ষণই হয়তো এধরণের পর্যটনের জনপ্রিয়তা দিন দিন আরও বাড়িয়ে তুলবে।
