‘বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই’: আরজে রাসেল, ভয়, ভূত এবং অনেক কিছু!

'বিশ্বাস করেন, রাসেল ভাই, এমন ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।'—সামাজিক মাধ্যমে এমন কৌতুক চোখে পড়ে প্রায়ই। কিন্তু কে এ রাসেল ভাই? কেন-ই-বা লোকে অপ্রত্যাশিত কোনো বিষয়ের সঙ্গে জুড়ে দেন তাকে?
আসলে ভূতের গল্পপ্রেমীদের কাছে 'রাসেল ভাই' শুধুই একজন মানুষ নন, এক অব্যাখ্যেয় আবেগের নাম।
শহরতলীর রাতে, যখন চারপাশ ঢেকে যায় অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়, তখনই হঠাৎ করেই কানে ভেসে আসে তার কণ্ঠ। নিঃশব্দে হেডফোনের ভেতর ঢুকে পড়ে এক রহস্যময় স্বর—"বিশ্বাস করা না করাটা আপনার ব্যাপার। আমি রাসেল, আছি সঙ্গে। ঘড়িতে সময় রাত ১১টা বেজে ৫৯ মিনিট।"
এ কণ্ঠ কেবল ভয় পাইয়ে দেয় না—জাগিয়ে তোলে এক অদ্ভুত নেশা। এ কণ্ঠকে ভর করেই ভয় কাঁপে সকলে, আবার এ কণ্ঠই হয়ে ওঠে নির্ঘুম রাতের আশ্রয়।
তাই তিনি রাসেল ভাই—'ভূত এফএম'-এর সে কিংবদন্তি কণ্ঠস্বর।
ভূত এফএম দিয়ে তার ভয়ের গল্পের রাজত্ব শুরু হয়েছিলো, সময়ের পরিক্রমায় এখন তিনি আছেন ভূত ডটকমের সঙ্গে। রেডিও ফুর্তি থেকে শুরু করে এখন তৈরি করেছেন নিজের জগৎ।
লাখো রাতজাগার হৃদয়ে আরজে রাসেল জড়িয়ে আছেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
আশরাফুল আলম থেকে আরজে রাসেল
কণ্ঠের জাদু দিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে চলা আশরাফুল আলম, যিনি সবার কাছে পরিচিত রাসেল নামে, তার পথচলা শুরু হয়েছিল বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজের মাধ্যমে।
তবে রেডিওর প্রতি টান তৈরি হয়েছিল আরও আগে। বাবা-মায়ের হাত ধরে সৌভাগ্য হয় রেডিওর জগতে পা রাখার। ইচ্ছে ছিলো চলচ্চিত্রকার হওয়ার।
তাই থিয়েটারে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন দীর্ঘদিন। কণ্ঠ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জানাশোনা সেখানেই হয়। গাইতে গাইতে যেমন গায়েন হয়, কণ্ঠ নিয়ে কাজ করতে করতে আশরাফুল আলম ওরফে রাসেল হয়ে ওঠেন কণ্ঠশিল্পী।
প্রথম সুযোগ আসে কেয়া কসমেটিক্সের হাত ধরে। রাসেল বলেন, "সে সময় কেয়া কসমেটিক্স নতুন ভয়েসওভার আর্টিস্ট খুঁজছিলো। শারমিন লাকি আপা বললেন, 'সবার ভয়েস নেওয়া হচ্ছে রাসেল, তুইও একটা দিয়ে দে।' আমি ওখানে ভয়েস দিতে যাই। আমার ভয়েস সিলেক্টেড হয় এবং তারপর থেকেই আমি ভয়েসওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করি।"
রেডিও ফুর্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় শো 'ভূত এফএম'-এর কথা বললে উঠে আসে আরজে রাসেলের নাম।
ভয়ের গল্পকে রহস্য, আবেগ আর শব্দের শৈলীতে সাজিয়ে শ্রোতাদের মনে গেঁথে দেওয়ার যে দক্ষতা, তাতে শুরু থেকেই এ শো হয়ে উঠেছিলো অনন্য।
ভয় থেকেই দারুণ কিছু!
প্রথমদিকে রেডিও ফুর্তিতে ভয়েসওভার আর্টিস্ট হিসেবেই কাজ শুরু করেছিলেন আরজে রাসেল। 'হ্যালো ঢাকা' নামের একটি শো-এর মাধ্যমে ঢাকা শহরের যাপিত জীবন নিয়ে গল্প করতেন মানুষের সঙ্গে।
তবে এ যাত্রার মাঝেই ঘটে যায় অদ্ভুত কিছু ঘটনা—নিজের বাসায়ই একের পর এক ভয়ের অভিজ্ঞতা হতে থাকে তার। অন্ধকারে ধুপধাপ আওয়াজ থেকে শুরু করে খাবার টানাটানির আওয়াজ—সবমিলিয়ে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল তখন।
সেসব গল্প পরদিন অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। কেউ ভয় পেত, কেউ হাসত—সবার চোখমুখ জুড়ে থাকতো কৌতূহল।
রাসেলের জীবনে ভয়ের শুরুটা হয়েছিলো শৈশবেই। ছোটবেলায় গল্পের বই পড়ে ভীষণ ভয় পেতেন তিনি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে ভয়ের জগতে যুক্ত হলো রিং, মিররস, দ্য এক্সরসিজম অব এমিলি রোজ-এর মতন সিনেমা। বলা যায়, তার মনের গভীরে থাকা ভয়ই বপন করেছিলো ভূত এফএম-এর বীজ।
রাসেল বলেন, 'আমার মনে হতো, যদি সহকর্মীরা আমার বলা গল্প শুনে ভয় পায়, তাহলে আরও অনেক মানুষ ভয় পাবে। তখনই ভাবলাম, একটা হরর শো শুরু করা যায়।'
তবে শুরুটা সহজ ছিল না। প্রথমদিকে কর্তৃপক্ষ এ প্রস্তাবে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কারণ, আমাদের মিডিয়া পরিকল্পনা বলিউড কিংবা পাশের দেশের সফল উদাহরণ দেখেই এগোয়। গল্প বলার মতো হরর শো তখন সেভাবে প্রচলিত ছিল না।

'পরে কর্তৃপক্ষ জানায়, যেহেতু কোনো স্লট ফাঁকা নেই, এটা শুরু করলেই মধ্যরাতেই করতে হবে। বিষয়টা এমন না যে ভয় পাওয়ানোর জন্য এ স্লট দেওয়া। আসলে ওই সময়টাতে তেমন কোনো বিজ্ঞাপন যায় না। ওই সময় আমি দুই ঘণ্টা কথা বললে কেউ কোনো কিছু মনে করবে না। এরপর ২০১০ সালে শুরু হয় আমাদের হরর শো ভূত এফএম', বলেন রাসেল।
মজার বিষয় হচ্ছে, প্রথম পর্বেই বিপুল মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় ভূত এফএম। অসংখ্য মানুষ এসএমএসের মাধ্যমে জানায় তাদের ভালো লাগার কথা।
এরপর প্রায় ১০ বছর চলেছে ভূত এফএমের যাত্রা। শুরু থেকেই রাসেলের ভাবনায় ছিল সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস নিয়ে তৈরি গল্পগুলোকে রেডিওর পর্দায় তুলে আনা। আর তাতে সফলও হন।
"আমার মনে আছে, যখন এয়ারটেল ভূত এফএম–এর স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হলো, তখন শো'টি নিয়ে নানা পত্রপত্রিকায় লেখা হতো। আর আমার বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যে নাম ছিল—আশরাফুল আলম, এবং আমি যে একজন কপিরাইটার—সে পরিচয়টা আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যেতে শুরু করে।
"বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে যখন কোনো ক্লায়েন্টের কাছে পিচ নিয়ে যেতাম, তখন বলা হতো, 'ও আরজে রাসেল! একটা গল্প বলতে এসেছে, শুনে দেখি উনি কী বলেন।' এভাবেই আমার বিজ্ঞাপনের ক্যারিয়ার পুরোপুরি চাপা পড়ে যায় আরজে রাসেলের নতুন ক্যারিয়ারের চাপে। তখন থেকেই আমাকে মানুষজন এ নামেই চিনতে শুরু করে," বলেন রাসেল।
কণ্ঠ, শব্দ, উচ্চারণ নিয়েই ভয়েসওভার
রাসেলের মতে, কণ্ঠ দিতে গেলে সর্বাগ্রে আবশ্যক শুদ্ধ উচ্চারণ। দূর করা প্রয়োজন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার ভয়। শিখতে হবে আবেগ নিয়ে কণ্ঠে খেলা করার প্রক্রিয়া। আর তার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত চর্চা।
হরর কনটেন্টে আবহসঙ্গীতের ব্যবহার অনেক সময়ই ভয় তৈরি করার কৌশল হিসেবে দেখা যায়। তবে রাসেল এ ধারণার বিপরীতচারী। 'আমার মনে হয়, আমরা অনেক সময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করি শুধু ভয় পাওয়ানোর জন্য। কিন্তু এটা ঠিক নয়,' বলেন তিনি।
তার মতে, আবহসঙ্গীত হওয়া উচিত এমন, যা কনটেন্টের আবহ ও কথার সঙ্গে মিল রেখে কাজ করবে, একে উঁচু করে তুলবে—কিন্তু কখনোই কণ্ঠ বা গল্পের মূল উপাদানকে ছাপিয়ে যাবে না। 'ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কনটেন্টের পরিপূরক হবে, গল্প বলার ধরনকে সমর্থন দেবে।'
এ দর্শনের ভিত্তিতে রাসেল ও তার দল ২০১০ সাল থেকে একটি নির্দিষ্ট 'সিগনেচার' মিউজিক ব্যবহার করে আসছেন। তারা এমন একটি সাউন্ড বেছে নিয়েছেন যা হরর গল্প বলার নিজস্ব ধরনকে পরিপূরক করে—যেখানে কোনো অতিরঞ্জনতা নেই, বরং সঙ্গীতটি গল্পের আবহের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশে গেছে।
শেষ থেকে শুরু
ভূত এফএমের কার্যক্রম চলেছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু যেই গল্প শুনতে শুনতে আপনার ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস, তা আচমকা বন্ধ হয়ে গেলে শ্রোতা হিসেবে কেমন লাগে বলুন তো? ভূত এফএমের নিয়মিত শ্রোতারাও আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি। আরজে রাসেলের কাছে ফোনকল, এসএমএসের মাধ্যমে তারা নিয়মিত পাঠাতে থাকেন ভূতের গল্প শোনানোর আর্জি।
'তখন মনে হচ্ছিল, মানুষ এত ভালোবাসা দিচ্ছে, এত সাহস দিচ্ছে—আমার আবার শুরু করা উচিত,' বলছিলেন রাসেল।
২০২০ সালের একেবারে শুরুতে, গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। জানতে চাওয়া হয়—আগ্রহ আছে কি না তাদের সঙ্গে কাজ করার। 'মানুষ যেহেতু এখন বেশিরভাগ সময় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাটায়, আমি তখন ভাবলাম এ শো'টাকেও সেখানে নিয়ে আসা উচিত,' বলেন তিনি।
সে ভাবনা থেকেই শুরু হয় ভূত ডটকম-এর নতুন অধ্যায়—স্বাধীন অ্যাপের সঙ্গে যৌথভাবে শুরু করেন কাজ। ভক্তের ভালোবাসা তো আর যেমন তেমন নয়। ভূত ডটকম-এর দৌলতে অচেনা অ্যাপ 'স্বাধীন' মাত্র ৯ মাসে অর্জন করে দেড় মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার। 'অডিয়েন্স আমার পাশে আছে— এটা আমাকে জানিয়েছিল। তাদের জন্যই আমার ফিরে আসা,' বলেন রাসেল।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ভূত ডটকম-এর যাত্রা চলেছিল স্বাধীন অ্যাপের ছায়াতলে। এরপর, জুলাই মাস থেকে রাসেল নিজ উদ্যোগে শুরু করেন শো-এর নতুন অধ্যায়—এবার ইউটিউবে। নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন একটি ছোট্ট স্টুডিও। সেখান থেকেই শুরু হয় 'ভূত ডটকম'-এর নতুন গতিপথ।
প্রতিযোগিতা বেশি ইউটিউবে
রেডিও, অ্যাপ, আর ইউটিউব—তিনটি মাধ্যমেই কাজ করেছেন রাসেল। অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন, প্রতিটি মাধ্যমের কাজের ধরন ভিন্ন। রেডিওর শ্রোতা নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে শোনে। সে সময় শুনতে না পারলে পুরো অনুষ্ঠানটিই হাতছাড়া হয়ে যায়।
'রেডিওতে যখন কাজ করতাম, তখন অন্য কোথাও সে কনটেন্ট প্রকাশিত হতো না,' বলেন রাসেল। 'তখনকার প্রস্তুতি ছিল আলাদা। অতিথি আসতেন, আমরা শো করতাম—একবার সম্প্রচারিত হলেই সেটি আর শোনা যেত না। পাইরেসি হলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।'
ইউটিউবে এখন নিয়মিত না হলেও সপ্তাহে একদিন লাইভ করেন রাসেল। কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জের মাত্রা অনেক বেশি। 'ইউটিউবে আমার অডিয়েন্স ধরে নেয়, কনটেন্ট সবসময় থাকবে। তারা ব্যস্ত থাকলে পরে শুনে নেয়। কিন্তু ইউটিউবে অপশন অনেক বেশি। ড্রপ-আউট হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। যদি প্রথম এক-দেড় মিনিটেই শ্রোতাকে আকর্ষণ করতে না পারি, তাহলে তাকে হারিয়ে ফেলবো—হয়তো আমার চ্যানেলে নাও ফিরতে পারে।'
স্বাধীন অ্যাপে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল একরকম। 'ওখানে আমরা শুধু একটি শো করতাম,' জানান রাসেল। 'কিন্তু ইউটিউবে একই শো-এর জন্য নাম দিতে হয়েছে, থাম্বনেইল বানাতে হয়েছে। কারণ ইউটিউবের ফরম্যাটই এমন। সেখানে কিছু শুনতে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই আরও দশটা সাজেশন আসে।'
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করা মানেই শুধু কনটেন্ট বানানো নয়, বরং প্ল্যাটফর্মটির অ্যালগরিদম ও ইকোসিস্টেম বোঝা জরুরি। রাসেলের ভাষায়, 'অডিয়েন্সকে বুঝে কনটেন্ট তৈরি করতে হয়। এখানে কাজটা চার-পাঁচগুণ বেড়ে যায়, কারণ এটা একটা ফুল প্রোডাকশন। লাইভে কোনো ভুল করলে সেটা ঠিক করা যায়। ইউটিউবে সে সুযোগ পাওয়া যায় না। এজন্য অনেক সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। সাধারণত কন্টেন্টের ফরম্যাট বদলায় না, কিন্তু আনুষঙ্গিক কাজগুলো ইউটিউবে বেশি।'

দীর্ঘসময়ে বদলেছে শ্রোতার পছন্দ
'আমাদের দর্শকেরা এখন ডিজিটাল মিডিয়ার ভোক্তা,' বলেন রাসেল। স্মৃতিচারণায় ফিরে গেলেন এক সময়ের কথা—যখন রেডিও ছিল মানুষের বিনোদনের একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
'একটা সময় আমরা যখন রেডিও শুনতাম, তখন হেডফোন কানে লাগিয়ে রেডিওটাই চালু রাখতাম। ফোনে শুধু রেডিওই ছিল, ইন্টারনেটের অপশন ছিল খুব কম। বর্তমান সময়ের তুলনায় ধীরে চলত ইন্টারনেট, এমনকি খরচও বেশি ছিল। তখন আমি জানতাম, আমার শ্রোতা দুই ঘণ্টা আমার কথাই শুনবে।'
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন।
ভূত ডটকম শুনতে শুনতেই একজন শ্রোতা হয়তো অন্য কোনো অ্যাপে ব্রাউজ করছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রল করছেন বা মেসেজের উত্তর দিচ্ছেন।
শ্রোতাদের আচরণে এ দীর্ঘ সময়জুড়ে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে—জানতে চাওয়া হলে রাসেল একটু ভেবে নিয়ে বলেন, 'মনোযোগের ধরনে একটা বদল এসেছে।'
"যদি কনটেন্ট ভালো না হয়, শ্রোতার মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাবে। ২০১৬ সালের পর থেকে রেডিওতে 'ড্রপ-আউট'-এর হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারতাম, মানুষ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
তার ভাষায়, এখনকার শ্রোতারা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়—তারা হয়তো কোনো কনটেন্টকে মাত্র ৫ মিনিট সময় দেবে। এ ৫ মিনিটেই তাদেরকে টানতে না পারলে, তারা চলে যাবে, আর ফিরে আসবে না।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আগ্রহ এবং মানসিকতা বদলায়—এ সত্যটাও রাসেল বুঝতে শিখেছেন অভিজ্ঞতা থেকে।
'আগের শ্রোতারা ছিল অ্যানালগ সময়ের মানুষ, আর এখনকার শ্রোতারা ডিজিটাল দুনিয়ার বাসিন্দা। এ ফ্যাক্টরগুলো খুব শক্তভাবে কাজ করে,' বলেন তিনি।
শ্রোতাদের ভালোবেসে রাসেল আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির স্বপ্ন দেখেন—যেখানে নির্বিঘ্নে তার শ্রোতারা ভূতের গল্প শুনতে পারবেন। তার কাজও এখন চলছে পুরোদমে।
ভূতের চলচ্চিত্রে ভাবনার ঘাটতি
বিশ্বের নানা দেশে ভৌতিক সিনেমা মানে শুধু ভয় নয়, বরং এক ধরনের নিখুঁত শিল্পচর্চা। সেখানে গল্প বলার ভঙ্গি, সিনেমাটোগ্রাফি, শব্দ এবং আলোর ব্যবহার—সবকিছুতেই থাকে পরিমিত ছাঁট।
কিন্তু বাংলাদেশের হরর সিনেমা সে জায়গায় কতটা এগিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে আরজে রাসেল তুলে ধরেন এক বাস্তব চিত্র।
চলচ্চিত্রে একাডেমিক পড়াশোনা রয়েছে রাসেলের।
সে অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলেন, 'আমাদের এফডিসিতে আগে যেসব ফিল্ম হতো, সেগুলো এখন আর হয়না। আপনি সেগুলোকে কমার্শিয়াল বা বাজে ফিল্ম বলতে পারেন। তারা কিন্তু তাদের দর্শকের কথা ভেবেই বানাতো। মানুষ হলে হুমড়ি খেয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখত।'
'এখন আমরা সিনেমা বানিয়ে ভাবি, আমার ডিরেক্টর বন্ধু বলবে, এটা দারুণ বানিয়েছিস তো! কিংবা ভাবি সোশ্যাল মিডিয়ার ফ্রেন্ড সার্কেল এটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করবে। এটাই আসলে মূল লক্ষ্য থাকে এখন,' মনে করেন রাসেল।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অনেক মেধাবি সিনেমাটোগ্রাফার কাজ করছেন, যারা আন্তর্জাতিক মানের কাজ দেখে শিখছেন বা পড়াশোনা করে ফিরেছেন।
কিন্তু চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো পরিচালক কতজন আছেন? রাসেল একদিকে যেমন স্বীকার করেন, 'আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক ট্যালেন্টেড ডিরেক্টর আছেন,' অন্যদিকে প্রশ্ন তোলেন, 'চ্যালেঞ্জটা কয়জন নিতে পারেন?'
হরর ঘরানার সিনেমা নিয়ে কথা বলার সময় রাসেল বলেন, 'হরর সিনেমায় নাইট সিন বেশি থাকে, যা নির্মাণে খরচও বেশি। ইমেজ তৈরির জন্য প্রোপার ইক্যুইপমেন্ট থাকা সত্ত্বেও আমরা সেটা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি না। হরর ফিল্মের ভাইরাল কন্টেন্টগুলো দেখবেন সিসিটিভি ফুটেজে শ্যুট করা। আমরা মনে হয়, পিকচারাইজেশন কীভাবে হবে—সে বিষয়ে চিন্তার জগত থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছি।'
'ফিল্ম মানুষের কাছে একটা ড্রিম ওয়ার্ল্ড। যার জন্য সিনেমা হলে বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। এর জন্য আসলে ভাবনার জায়গা তৈরি করা জরুরি,' বলেন তিনি।
রাসেলের মতে, মানুষকে ভয় পাওয়ানোটা খুব কঠিন। ডায়ালগ নির্ভর কাজ হলে মানুষকে হাসানো-কাঁদানো যায়। কিন্তু ভয় দেখাতে হলে পরিবেশ, মুড, রিদম—সবকিছু জানতে হয়। পড়াশোনা না করে হুট করে হরর সিনেমা বানাতে গেলে, সেটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের জন্য রোমান্টিক কিংবা অ্যাকশন ঘরানার সিনেমা যেন বহুদিন ধরেই এক ধরনের 'কম্ফোর্ট জোন' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরজে রাসেল বলেন, 'রোমান্টিক বা অ্যাকশন ফিল্ম আমাদের এখানে একটা কম্ফোর্ট জোন কিন্তু হরর? সেটা এখনো সে জায়গায় পৌঁছায়নি।' হরর সিনেমা বানাতে যে সময়, প্রস্তুতি এবং মানসিক স্থিতি দরকার, সেটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।
রাসেলের ভাষায়, 'এ ধরনের ফিল্ম বানানোর জন্য যে সময় লাগে, সে সময় দিতে লোকজন রাজি হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। দিনের পর দিন এ বিষয়ে কাজ করবে—এটা অনেকের জন্যই চ্যালেঞ্জিং।'

তবে এ সীমাবদ্ধতা শুধু বাংলাদেশের নয়, তা স্পষ্ট করে তিনি বলেন, 'আপনি শুধু বাংলাদেশকেই দোষ দিতে পারবেন না। ভারতেই কয়টা হরর ফিল্ম হয়েছে, যেটা দেখে আপনি বলবেন, এটা ক্ল্যাসিক একটা কাজ হয়েছে? এমনকি হলিউডেও হরর ফিল্মের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।'
পিছু ছাড়েনি সমালোচনার কাঁটা
দর্শকের ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন, তেমনি সমালোচনাও রাসেলকে পিছু ছাড়েনি। তিনি অকপটে স্বীকার করেন—হরর গল্প বলার এ যাত্রায় অনেকেই গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি একটি গল্পের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে একজন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখেন একটি গলাকাটা ঘোড়া। গল্পটি যদি কোনো অজানা ব্যক্তির, যেমন নারায়ণগঞ্জের জনৈক সেলিম সাহেবের মুখ থেকে আসে, তাহলে সেটিকে বিশ্বাস করা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে রাসেলের মতে, গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে গল্পকারের সঙ্গে শ্রোতার সম্পর্কের ওপর। 'আপনার বাবা-মা যদি একইরকম, এমনকি আরও অবিশ্বাস্য গল্প বলেন, তখন আপনি সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন, কারণ আপনি জানেন, তারা আপনাকে মিথ্যা বলবেন না।'
গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছাড়াও আরেকটি সাধারণ অভিযোগ রাসেলের কানে এসেছে—'আগের পর্বের চেয়ে এ পর্বটা তেমন ভালো হয়নি।' এ ধরনের মন্তব্য তিনি বহুবার শুনেছেন।
তবে তিনি থেমে থাকেননি। বরং প্রতিটি পর্বে আগের চেয়ে ভালো করার চেষ্টা করেছেন, গল্প বাছাইয়ে এনেছেন সতর্কতা ও বৈচিত্র্য। তবুও মানুষের মন্তব্য থামাতে পারেননি, আর তাতেই যেন প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রেরণা খুঁজে পান।
রাসেলকে গল্প বলতে সাহায্য করেন তারই কিছু সহযোগী, যারা দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে সংগ্রহ করেন গল্প। সে-সব গল্পই উঠে আসে ভূত ডটকমে।
রাসেল ভাই কি ভূত দেখেছেন?
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ভূতের গল্প শুনিয়ে চললেও রাসেল নিজে কখনো কোনো ভূত দেখেননি। তবে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে কিছু অলৌকিক, রহস্যময় ঘটনা—যা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এমনই একটি বিস্ময়কর রাতের অভিজ্ঞতা তিনি জানান।
সেদিন তার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছিলেন দুইজন অতিথি—একজন ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের বিখ্যাত 'ভূতের গলি' থেকে, আর আরেকজন এসেছিলেন কুড়িগ্রাম থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, অনুষ্ঠান অনএয়ার হওয়ার আগে সবাই মিলে সবার গল্প শুনতেন, যেন অতিথিদের গল্পের সত্যতা যাচাই করা যায় এবং কেউ যেন অভিযোগ না তুলতে পারে যে সব বানানো।
রাসেল তখন দেখেন, কুড়িগ্রাম থেকে আসা ছেলেটি সেন্ট্রাল রোড থেকে আসা ছেলেটিকে দেখে ঢুকেই বলে ওঠে—'আপনি এসেছেন! আপনি তো সে গল্পটা বলবেন, যেটা আপনার বাসার ছাদে নারকেল গাছ নিয়ে ঘটেছিল, তা-ই না?'
অবাক হয়ে যান সবাই। কারণ দুজনেই এসেছেন সম্পূর্ণ আলাদা সূত্রে, একজনের গল্প আরেকজনের জানার কথা নয়। ছেলেটি আরও বলে, সে শুধু গল্পটা জানে না, বরং কার সঙ্গে আগে কী ঘটেছে, এমনকি কার ভবিষ্যতেও কী ঘটতে পারে, তাও বলে দিতে পারে।
এ রহস্যময় ক্ষমতার পেছনের গল্প শুনে হতবাক হন রাসেল। জানতে চান, কীভাবে পেলেন এ আশ্চর্য ক্ষমতা। কুড়িগ্রামের ছেলেটি জানায়, একদিন কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক পাগলসদৃশ মানুষ তাকে ক্ষুধার কথা বলে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ছেলেটি বাড়ি থেকে ভাত এনে লোকটিকে খাওয়ায়। এরপর থেকে প্রতিদিনই সে লোকটিকে খাওয়াত এবং ধীরে ধীরে অজানা এ ক্ষমতা তার মধ্যে জন্ম নিতে থাকে।
'সামনাসামনি কোনোদিন ভূত দেখিনি,' বলেন রাসেল, 'কিন্তু এমন অলৌকিক পরিস্থিতির মুখোমুখি যে হয়েছি, সেটা বলা যায়।'
ভূতের গল্প শুধু বিনোদন নয়—এ এক আবেগ, যা বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হোক সেটা আকস্মিক ঝড়বৃষ্টি, কিংবা নিস্তব্ধ মধ্যরাত—ভূতের গল্পের আবেদন সর্বজনীন। নানা প্রজন্ম ধরে এ গল্পগুলো মানুষের কল্পনার খোরাক হয়ে থেকেছে।
এ আবেগময় ধারায় কাজ করলেও রাসেলের বিশ্বাস, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গল্প বলার ধরনেও আসা দরকার নতুনত্ব। বিশেষ করে যারা এখন এ অঙ্গনে আসতে চান, তাদের প্রতি তার পরামর্শ—শুধু গল্প বললেই চলবে না, সে গল্পে থাকতে হবে ফরম্যাটের নতুনতা, ভাবনার ভিন্নতা।
রাসেলের ভাষায়, 'এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক স্মার্ট। আমাদের সময় ইন্টারনেট থেকে একটা তথ্য বের করতেই অনেক সময় লাগত, কষ্ট করতে হতো। এখন তাদের হাতে পুরো দুনিয়া। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভাবতে হবে—এ জনরায় আরও কী ফরম্যাট যোগ করা যায়, নতুন কী আইডিয়া নিয়ে আসা যায়।'