‘আমি এখনো শেষ করিনি’—আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার ইঙ্গিত কমলা হ্যারিসের
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি হয়তো আবারও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। খবর বিবিসির।
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসিকে এই সাক্ষাৎকার দেন কমলা। কোনো ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে দেওয়া এটি তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার। এতে হ্যারিস বলেন, ভবিষ্যতে একজন নারী প্রেসিডেন্ট হবেন তা নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী—আর সেটি 'সম্ভবত' তিনি নিজেই হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গত জাতীয় নির্বাচনে কমলা হ্যারিস ডেমোক্রেট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। তবে ট্রাম্পের কাছে পরাজয়ের পর ২০২৮ সালের নির্বাচনে ফের প্রার্থিতা জানানোর এটাই তার সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত। যদিও সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে ডেমোক্র্যাটিক দলের পরবর্তী প্রার্থী হিসেবে তাকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে, তবে হ্যাসিস এসব জরিপকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
বিবিসির 'সানডে উইথ লরা কুয়েনসবার্গ' অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি তার সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পকে "একজন স্বৈরাচারী" হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন, নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প সম্পর্কে যে সতর্কবার্তা তিনি দিয়েছিলেন, তা এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
'আমি এখনো শেষ করিনি'
রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক বছর আগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর ডেমোক্র্যাটরা এখনো তাঁদের এই পরাজয়ের কারণ খুঁজছে, যেখানে বেশিরভাগ দায় দেওয়া হচ্ছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর– আরও আগেই তার প্রার্থিতা থেকে সরে না দাঁড়ানোর জন্য।
তবে এমন প্রশ্নও উঠেছে, পরে প্রার্থী হওয়া হ্যারিস কি আরও ভালোভাবে প্রচারণা চালাতে পারতেন? বিশেষ করে অর্থনীতি ইস্যুতে তার বার্তা কি আরও পরিষ্কার হওয়া উচিত ছিল?
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হ্যারিস আবারও হোয়াইট হাউসের পথে ফেরার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, তার নাতি-নাতনীরা জীবদ্দশায় একজন নারী প্রেসিডেন্টকে দেখবে।
যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, সেই নারী কি তিনি নিজেই হবেন, হ্যারিস হেসে বলেন, "সম্ভবত।" অর্থাৎ, তিনি আবারও প্রার্থিতা বিবেচনা করছেন।
তবে তিনি জানান, এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি, কিন্তু রাজনীতিতে তার ভূমিকা এখনো শেষ হয়নি।
"আমি এখনো শেষ করিনি," বলেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। "আমার পুরো জীবনটাই জনগণের সেবার জন্য নিবেদিত—এটা যেন আমার অস্থিমজ্জায় মিশে আছে।"
জরিপ নয়, বিশ্বাসে এগোনো
যখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, বর্তমান জরিপে তিনি এমনকি হলিউড অভিনেতা 'দ্য রক' ডোয়েন জনসনের চেয়েও পিছিয়ে আছেন, হ্যারিস বলেন, "আমি কখনোই জরিপের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিইনি। যদি শুনতাম, তাহলে প্রথমবারে এ পদে লড়তাম না, এমনকী হয়তো ভাইস প্রেসিডেন্ট পদেও নয়—আর অবশ্যই আজ এই জায়গায় থাকতাম না।"
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প সম্পর্কে তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো—যে তিনি একজন ফ্যাসিবাদী নেতার মতো আচরণ করবেন ও সরকারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন—এখন পুরোপুরি সত্য হয়েছে।
"তিনি (ট্রাম্প) নিজেই বলেছিলেন, তিনি বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন—এবং সেটাই তিনি করেছেন," হ্যারিস বলেন।
কমলা হ্যারিস উদাহরণ দেন, কৌতুক অভিনেতা জিমি কিমেলকে এবিসি নেটওয়ার্ক থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার ঘটনার। এই বরখাস্তকে ট্রাম্প সমর্থন দেন।
কট্টর ডানপন্থী ইনফ্লুয়েন্সার চার্লি কার্কের মৃত্যুকে নিয়ে কিমেলের ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যের পর ট্রাম্প-নিযুক্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।
হ্যারিস বলেন, "আপনি দেখুন, কিভাবে তিনি ফেডারেল সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক ব্যঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে। তার মানসিকতা এতটাই নাজুক যে সামান্য কৌতুকও সহ্য করতে পারেন না, আর এজন্য পুরো একটি গণমাধ্যমকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করেছেন।"
করপোরেট যুক্তরাষ্ট্রের নতজানু মনোভাব
হ্যারিস সমালোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী নেতাদের, যারা তার মতে, ট্রাম্পের ইচ্ছার কাছে অতিমাত্রায় নতি স্বীকার করেছেন।
"অনেকেই শুরু থেকেই তার সামনে নতজানু হয়েছেন—তাঁরা ক্ষমতার কাছে থাকতে চান। এরা হয়তো কোনোকিছুর অনুমোদন পেতে চান, অথবা তদন্ত এড়াতে চান," তিনি বলেন।
হোয়াইট হাউস অবশ্য হ্যারিসের মন্তব্যকে উপহাস করেছে।
প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র অ্যাবিগেইল জ্যাকসন বলেন, "কমলা হ্যারিস যখন বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হলেন, তখনই তার বোঝা উচিত ছিল—আমেরিকান জনগণ তার হাস্যকর মিথ্যা কথায় আগ্রহী নয়।"
"হয়তো তিনি বুঝেছেনও, তাই এখন বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বসে অভিযোগ করছেন," যোগ করেন জ্যাকসন।
১০৭ দিনের প্রচারণা
হ্যারিস সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন তার নির্বাচনী আত্মকথা '১০৭ ডেজ'। জো বাইডেনের সরে দাঁড়ানোর পর ঠিক ১০৭ দিনই সময় পেয়েছিলেন কমলা নির্বাচনি প্রচারের জন্য।
বিবিসিকে দেওয়া তার পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি যুক্তরাজ্যে প্রচারিত হবে আগামীকাল রোববার সকাল ৯টায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর ৩টায়)।
ডেমোক্র্যাটদের আত্মসমালোচনায় হ্যারিসের অবস্থান
ডেমোক্র্যাট শিবিরে অনেকেই মনে করেন, হ্যারিসের দুর্বল নেতৃত্ব ও বিভ্রান্ত বার্তাই ছিল তার পরাজয়ের মূল কারণ—শুধু বাইডেনের বিলম্ব নয়।
যখন তাকে প্রশ্ন করা হয় কী ভুল হয়েছিল, হ্যারিস বলেন, প্রচারণা শুরু করতে দেরি হয়ে যাওয়াই ছিল মূল বাধা।
তিনি বলেন, "সময় এত কম ছিল যে জেতার বাস্তব সুযোগই ছিল না।"
নতুন করে শক্তি সঞ্চয়
লন্ডনের বিলাসবহুল হোটেলের সোনালি সাজসজ্জায় বসে সাক্ষাৎকার দিতে দিতে হ্যারিসের চোখেমুখে ছিল আত্মবিশ্বাসের ঝলক। হোয়াইট হাউসের ঝলমলে অন্দরমহল থেকে দূরে থাকলেও ক্ষমতার স্বপ্ন তিনি এখনো ছাড়েননি।
আগে যখন তাকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন করা হতো, উত্তর দিতেন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে—"হয়তো, হয়তো না", বা "এখন সেটা ভাবছি না।"
কিন্তু এবার তার কণ্ঠে স্পষ্টতা ছিল বেশি। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের নাম সামনে আনলেন। যদিও তিনি প্রার্থিতা করার কোনো চূড়ান্ত ঘোষণা এখনো দেননি।
গত নির্বাচনে পরাজয়ের তিক্ততা সত্ত্বেও তিনি যে আবারো লড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন—এটিও অনেকের কাছেই বিস্ময়কর।
"হায় ঈশ্বর, আমাদের দেশের কী হবে?"—নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর তিনি নাকি বারবার এই বাক্যই বলেছিলেন।
তিনি বলেন, পপুলার ভোটে ব্যবধান ছিল ২ শতাংশেরও কম, কিন্তু ইলেকটোরাল কলেজে ট্রাম্প ব্যাপক ব্যবধানে জয় পান।
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
যদিও হ্যারিস তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃঢ় সংকেত দিয়েছেন, ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব এখনো দিকহারা।
একটি মধ্য-বামপন্থী দল কীভাবে এক ডানপন্থী জনতোষণবাদী নেতাকে মোকাবিলা করবে? সেক্ষেত্রে ট্রাম্পবিরোধিতাই কি যথেষ্ট, নাকি অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ইস্যুতে আরও জোরালো অবস্থান নিতে হবে?
যখন হ্যারিসকে জিজ্ঞাসা করা হয় কেন তার প্রচারণা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সেভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি, তিনি বলেন, "সময় কম ছিল।"
তিনি স্বীকার করেন, ২০২৪ সালের প্রচারণায় আবাসন ও চাইল্ড কেয়ারের মতো ইস্যুতে তিনি নিজের অবস্থান আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেননি।
যদিও তিনি আরো সময় পেলেও, তার বার্তা কতটা প্রভাব ফেলত তা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বিমত আছে।
হ্যারিস এখনো তার রাজনৈতিক মর্যাদা বজায় রেখেছেন। তার চারপাশে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা, সূক্ষ্মভাবে সময়মাফিক পরিকল্পনায় চলছেন তিনি, এবং কয়েকটি বাছাইকৃত টিভি সাক্ষাৎকারের মধ্যেই সীমিত রেখেছেন নিজের জনসংযোগ।
এই মুহূর্তে তিনি তাঁর বইটির প্রচারে ব্যস্ত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নয়। তবে হ্যারিসের কথাবার্তা ও আত্মবিশ্বাস শুনে মনে হয়—এটাই হয়তো আরেক দফা নির্বাচনি যাত্রার সূচনা।
